ফিরে দেখা: তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৬
৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৯:০৬
দুয়ারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে এই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ। প্রার্থী মনোনয়ন, প্রার্থী বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও প্রতীক বরাদ্দের সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে বৈধ প্রার্থীরা সবাই নির্বাচনি প্রচারও শেষ করেছেন। এখন কেবল ভোটের অপেক্ষা। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) ভোট আয়োজনের সব প্রস্তুতি নিয়েছে। ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে সেই ভোটগ্রহণ। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে আরও ১১টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য আগের জাতীয় নির্বাচনগুলোর সব তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা।
পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরই দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার দুয়ার বন্ধ হয়ে শুরু হয় সামরিক শাসন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠন এবং জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করলেও সেই সংসদ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে এর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এর কিছুদিন পর থেকেই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরশাদের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধেও জনমত গড়ে উঠতে থাকে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে এরশাদ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে থাকেন। পরে ১৯৮৫ সালে গণভোটও আয়োজন করেন তিনি। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ৯৪ শতাংশেরও বেশি আস্থা ভোট ওই গণভোটে অর্জন করিয়েছেন দেখিয়ে এরশাদ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন।
এর আগে থেকেই তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল আলোচনায়। ১৯৮৪ সালের ২৬ এপ্রিল এই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে সে তারিখ দুই বার পরিবতৃন করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন- ফিরে দেখা: প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৩
১৯৮৫ সালের ১৭ মে বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসুদকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। নির্বাচন কমিশনের অধীনেই তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের আগেই ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি গড়ে তোলেন এরশাদ। এই দল ছাড়াও আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে জিয়াউর রহমানের গড়ে তোলা বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট এই নির্বাচন বর্জন করে।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ দুই হাজার ১৫৪ জন জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। বাছাই ও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষে চূড়ান্ত প্রার্থী দাঁড়ায় এক হাজার ৫২৭ জনে। নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫৬ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪৫৩ জন। ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হননি।
আরও পড়ুন- ফিরে দেখা: দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৯
চার কোটি ৭৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৯ জন ভোটার ছিলেন এই নির্বাচনে। ভোট পড়ার হার ছিল ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ২৩ হাজার ২৭৯টি। ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা ছিলেন দুই লাখ ৯২ হাজার ৭২৭ জন। নির্বাচনে মোট খরচ হয় ১২ কোটি ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪১ টাকা।
জিয়াউর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই তৃতীয় নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন এরশাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। ভোটে তার দল জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয় পায়। আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছিল ৭৬টি আসনে। এ ছাড়া ১০টি আসনে জয় পেয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। পাঁচটি করে আসনে জয় পায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (এনএপি)। চারটি করে আসনে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও জাসদ (রব)। বাকশাল, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ (শাহজাহান সিরাজ) তিনটি করে আসনে জয়লাভ করে। দুটি আসন পায় ন্যাপ (মোজাফফর)। বাকি ৩২ আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
তৃতয়ী জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই। স্পিকার ছিলেন সামসুল হুদা চৌধুরী। ডেপুটি স্পিকার ছিলেন এম কোরবান আলী। ১৭ মাসের মাথায় ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জিয়াউর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, ভোটকেন্দ্র দখলসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও ওই নির্বাচনকে ভোট ডাকাতির নির্বাচন বলে অভিহিত করেন।
নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকেই বিরোধী দলগুলো সরকারিবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে বিরোধী দলগুলোর সংসদ সদস্যরা সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন। পরে ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারি করেন এরশাদ। ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেন।
তথ্যসূত্র:
১. নির্বাচন কমিশন
২. সংসদ সচিবালয়
৩. বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল, নেসার আমিন, ঐতিহ্য, ২০২৩
সারাবাংলা/টিআর
১৯৮৬ সালের নির্বাচন এরশাদ জাতীয় পার্টি জাতীয়-নির্বাচন তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংসদ নির্বাচন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ