Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে কারণে রংপুরে জাতীয় পার্টির শোচনীয় দশা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১০ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২১

রংপুর: এক সময়ের প্রচলিত কথা ছিল রংপুর অঞ্চলে ‘জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদই শেষ কথা’। কিন্তু সেই কথা এখন বদলে গেছে। এক সময়ের প্রভাবশালী এই রাষ্ট্রপতির হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি তার মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই রাজনীতিতে অবস্থান হারাতে থাকে। বর্তমানে দলটির জনপ্রিয়তা খোদ রংপুরেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। না হলে দলের দূর্গ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলেই যে শোচনীয় দশা তা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্পষ্ট হলো।

বিজ্ঞাপন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেও সারাদেশে জাপার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ১১টিতে। আর ২৬ আসনের মধ্যে রংপুর বিভাগে নয়টিতে লড়াই করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এই নয় প্রার্থীর মধ্যে জয়ী হয়েছেন মাত্র তিনজন। বাকি ছয় জনের কেউই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি। এ ছাড়া রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনেই জাপার প্রার্থী থাকলেও এই তিন জন বাদে আর কেউ জিততে পারেননি। এমনকি জামানত হারানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অনেকের।

বিজ্ঞাপন

অথচ এরশাদের বাড়ি রংপুরে হওয়ায় এই অঞ্চল এক সময় ছিল ‘লাঙ্গলের ঘাঁটি’। তাদের দখলে ছিল বৃহত্তর রংপুরের ২২টি আসন। কিন্তু দিনে দিনে তাতে ভাগ বসায় আওয়ামী লীগ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগে জাপার দখলে ছিল সাতটি আসন। গত রোববারের ভোটে তারও চারটি হারিয়েছে জাপা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের ওপর অতিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণে দলটির অবস্থা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে জাতীয় পার্টি রংপুর অঞ্চলে দুর্বল হয়ে পড়েছে, এ কথা মানতে নারাজ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

যেভাবে রংপুর অঞ্চলের মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন এরশাদ

আশির দশকে এরশাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখনও জাতীয় পার্টি রংপুরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। এরশাদের মূল জনপ্রিয়তা দেখা যায় ১৯৯০ সালে তার পতনের পর, যখন দুর্নীতির মামলায় তাকে কারাগারে যেতে হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায়ই এরশাদ ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন। অথচ ওই দুটি নির্বাচনে তিনি প্রচারের কোনো সুযোগ পাননি।

১৯৯১ সালে এরশাদ কারাগারে যাওয়ার পর এই অঞ্চলে লোকমুখে একটা কথা ছড়িয়েছিল যে, এরশাদকে ফাঁসি দেওয়া হবে। মানুষ তখন বলতে শুরু করে – ‘হামার রংপুরের ছাওয়ালরে ফাঁসি দেবে?’ (আমার রংপুরের ছেলেকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে?) এরপর থেকেই এরশাদের প্রতি মানুষের আবেগ ও সমর্থন পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেসময় থেকেই জাতীয় পার্টির লাঙ্গল রংপুরের মানুষের মনে আবেগের আসন পায়। অথচ সে কথার কোনো ভিত্তি ছিল না। কারণ, সেটি ছিল গুজব। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি রংপুর জেলার সবগুলো আসন থেকে বিজয়ী হয়।

এর পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত এরশাদ ও জাতীয় পার্টি রংপুর অঞ্চলে বেশ প্রভাবশালীই ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকেই প্রভাব কমতে থাকে। ২০০৮ সালে ছয়টির মধ্যে তিনটি এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দু’টি করে আসন পায় জাতীয় পার্টি। যদিও এরশাদ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন রংপুর অঞ্চলে তার ব্যক্তিগত প্রভাব ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির সেই প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে।

জাতীয় পার্টির অবস্থা যেভাবে শোচনীয় পর্যায়ে গেল

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার আসন সমঝোতার অংশ হিসেবে রংপুরের দু’টি আসনে প্রার্থী দেয়নি ক্ষমতাসীন দল। তবে রংপুরের ছয়টি আসনেই প্রার্থী দিলেও জাপা পেয়েছে মাত্র একটি। রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ ও জাপা প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফকে ব্যাপক ভোটে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবলু। এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে রংপুর-১ আসনে দীর্ঘ ৫২ বছরের জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটেছে। এতে করে জাপার ভবিষ্যৎ অন্ধকার রূপ নিল।

আর রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের ভোট পেয়েছেন ৮১ হাজার ৮৬১টি। এখানে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানী। তিনি ভোট পেয়েছেন ২৩ হাজার ৩২৬। তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীর কাছে ৫৮ হাজার ৫৩৫ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন জিএম কাদের। ওই আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু অন্য আসনগুলোয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন করলেও জি এম কাদেরের আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীও ছিলেন না। সেই সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন না।

এদিকে, লালমনিরহাটের তিনটি আসনকেই একসময় ‘জাপার দুর্গ’ বলা হলেও এরশাদের মৃত্যুর পর সেই দুর্গ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সেখানে শক্ত ঘাঁটি গাড়ে আওয়ামী লীগ, যার প্রতিফলন ঘটে গত রোববারের ভোটে। তেমনি গাইবান্ধা পাঁচটি আসনের দু’টিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হলেও জয়ী হতে পারেননি জাপার প্রার্থী। বাকি তিনটি আসনেও নৌকার কাছে পাত্তা পাননি জাপার প্রার্থীরা। একই চিত্র নীলফামারীতেও। জেলার চারটি আসনেই ভরাডুবি হয়েছে জাপার।

এরশাদের ভাগ্নে নীলফামারী-৪ আসনে এমপি আহসান আদেলুর রহমানকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। সমঝোতার নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেলও জিততে পারেননি। আর কুড়িগ্রামের চারটি আসনের দুটি নিয়ে সমঝোতা হলেও শুধু কুড়িগ্রাম-১ আসনে জাপার প্রার্থী বিজয়ী হন। কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাপার আরেক প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। তবে ছাড় পাওয়া ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাপার হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জয়ী হয়েছেন।

ভোটারদের দাবি, রংপুর অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে জাপা নেতাদের কোনো ধরণের যোগাযোগ নেই। কেউ কেউ বছরের পর বছর এলাকায় যান না, ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেন না। তাই রংপুরের মানুষ লাঙ্গল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন

জাতীয় পার্টির শোচনীয় অবস্থা বিশ্লেষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মহানগর কমিটির সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, দলটি যেন এখানে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে রংপুর অঞ্চলে জাতীয় পার্টির কোনো কর্মকাণ্ড নেই। শুধু মুখে লাঙ্গলের প্রচার। রংপুরের মাটি, লাঙ্গলের ঘাঁটি- এই কথায় ভোটাররা আর আকৃষ্ট হয় না। মানুষের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা নেই।’

তিনি বলেন, ‘রংপুর-৩ আসনে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচন করলেও আশপাশের আসনগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে দলের নেতাদের কর্মকাণ্ড ছিল না। মাঠপর্যায়ে কোনো ভূমিকা ছিল না। বড় কথা হলো, আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরতা তারা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। এসব নানা কারণে দলটির অবস্থা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ে, যা নির্বাচনে ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ভোটাররা।

তবে গত ১৫ বছর ধরে জাতীয় পার্টির উপর আওয়ামী লীগের প্রভাবের কারণেই দলটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এছাড়া গত দেড় দশকে জাতীয় পার্টি একাধিকবার তাদের গৃহবিবাদ মীমাংসার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতির শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হয়েছেন। জাতীয় পার্টির নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় হয়তো মধ্যস্থতা করেছেন, নয়তো সমঝোতা করেছেন।’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই দল কি নিজেদের দ্বারা পরিচালিত হয়, নাকি অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়? যখন দুই নৌকায় পা দিয়ে নানা কম সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার প্রশ্ন থাকবে তখন অন্যের আনুকূল্যে দলটার বিকাশ সাধিত হয়। অন্যের সুযোগ-সুবিধায় একটা দল মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না।

যা বলেন জাপা চেয়ারম্যান

সার্বিক বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘রংপুরে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে, প্রভাব কমে গেছে, জনসমর্থন কমে গেছে- ব্যাপারটা আসলে সঠিক নয়। ইচ্ছাকৃতভাবেই এসব কথা ছড়ানো হচ্ছে। সরকার-সমর্থকদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে যে, জাতীয় পার্টি শেষ। জাতীয় পার্টি আছে, থাকবে।

সারাবাংলা/পিটিএম

জাতীয় পার্টি রংপুর শোচনীয় দশা

বিজ্ঞাপন

সিইসিসহ নতুন ৪ কমিশনারের শপথ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:১০

আরো

সম্পর্কিত খবর