সরিষার আবাদ বেড়েছে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে
১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:০২
ঢাকা: দেশে সরিষার আবাদ বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে প্রায় তিন লাখ হেক্টর বেশি জমিতে এবার সরিষার আবাদ হয়েছে, ফলনও বাম্পার। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ ভাগ স্থানীয়ভাবে মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে সরকার। সে লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে বিভিন্ন কার্যক্রম। চলতি মৌসুমে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্য থাকলেও আবাদ হয়েছে ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে। গত মৌসুমে ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়। সে হিসেবে এবার ২ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে এই তেল জাতীয় ফসলটির আবাদ হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার ফসলের মাঠ জুড়ে হলুদের সমারোহ। সরিষার নয়ন ভুলানো সৌন্দর্য শুধু মৌমাছিকেই নয় আকৃষ্ট করছে সাধারণ মানুষদেরও। যেন সরিষায় ভাসছে পুরো দেশ। কৃষি কর্মকর্তা ও দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরিষা আবাদে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চাষিরা। এবার ফলনও ভালো হয়েছে। উৎপাদন বেশি হওয়ায় এখন শেষ হাসির অপেক্ষায় তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার ১২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্য থাকলেও আবাদ হয়েছে ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে। বৃষ্টির কারণে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সরিষার আবাদ কিছুটা কম হয়েছে। তবে গতবারের চেয়ে আবাদ বেড়েছে। ফলে এবার গতবারের চেয়ে উৎপাদনও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও মানুষ সরিষা তেল খাওয়া ভুলে গিয়েছিল। এখন সবাই সরিষা তেল খাচ্ছে। কারণ সয়াবিনের চেয়ে সরিষার তেলের উপকারিতা অনেক বেশি। চাহিদা বাড়ায় কৃষক সরিষা আবাদেও আগ্রহ দেখাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরিষার আবাদ বাড়াতে এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। স্বল্প মেয়াদী আমন আবাদের পর স্বল্প মেয়াদী সরিষার জাত আবাদে আগ্রহ তৈরির চেষ্টা করছি। বিভিন্ন জাত মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আমন আবাদ শেষে সরিষা আবাদ করেও বোরো ধান চাষ করা যাচ্ছে। এতে কৃষক সরিষা আবাদে আরও বেশি আগ্রহী হয়েছে।’
২০১৭-১৮ অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই বেড়েছে সরিষার আবাদ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরিষা আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে। পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২১ হাজার হেক্টর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টর এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল।
এদিকে ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২- এই পাঁচ অর্থবছরে সরিষার উৎপাদন যথাক্রমে ৬ লাখ, ৬ লাখ ৮৩ হাজার, ৭ লাখ ৫০ হাজার, ৭ লাখ ৮৭ হাজার ও ৮ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে সরিষার আবাদ হয় ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬০ হাজার টন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর, সমপরিমাণ জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ২৯ হাজার টন। তথ্যমতে, এবার ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। সেই হিসেবে চলতি মৌসুমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে।
দেশে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়াতে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৫ সালের জুনে। প্রকল্পের ব্যয় ২২২ কোটি ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত বছর ১৩ হাজার ৯৭৯টি প্রদর্শনী করা হয়। এসব প্রদর্শনীতে ৩ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল। তবে এবার প্রদর্শনীর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ১৩ হাজার ৫৭৪ টি প্রদর্শনী করা হয়েছে। এসব প্রদর্শনীতে বীজ ও সার সবই বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মুহম্মদ আরশেদ আলী চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের যে টার্গেট, সেই সঠিক ধারাতেই রয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৩ বছরে ৪০ শতাংশ আমদানি কমিয়ে আনার। প্রথম বছরে আমার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। দ্বিতীয় বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা আশা করি তাও পূরণ হবে। এ বছর তেলজাতীয় ফসলের আমদানি ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর আগামী বছরের মধ্যেই আমরা আমদানি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন শুধু তেলের চাহিদাই বিবেচনা করা হচ্ছে না, পুষ্টির কথাও বিবেচেনা করা হচ্ছে। যাতে সঠিক পুষ্টিটা কৃষকরা পায়। গ্রামে মাঠে গেলে এখন চারদিকে শুধু সরিষা। প্রকল্পের কারণে আমদানি ইতোমধ্যেই কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে গত বছর ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ আমদানি কমেছে। আশা করছি এ বছর ২৫ ভাগ আমদানি কমে আসবে।’
তথ্যমতে, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ৩ লাখ টন, যা চাহিদার ১২ শতাংশ। বাকি ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। এর মধ্যে আবাদ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও গতবারের চেয়ে এবার প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়েছে।
সরিষার আবাদ বাড়াতে একর প্রতি বা হেক্টর প্রতি সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্যে গতানুগতি জাতের পরিবর্তে বারি-১৪, বারি-১৭, বারি-১৮, বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। দুটি ধান ফসলের মাঝখানে সরিষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোপা আমনে স্বল্প জীবনকালের ধান ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-৮৭, বিনা ধান-৭ ও বিনা ধান-১৭ এগুলো রোপনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের। এরপর স্বল্পকালীন সরিষা বারি-১৪, বারি-১৭, বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা রোপন করা হয়।
গত বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এ বছর তা বাড়িয়ে ১২ লাখ বিঘাতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে উপকারভোগী হয়েছে ১২ লাখ পরিবার। প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের সরিষা বীজ ও রাসায়নিক সার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এবারও বীজ ও সার পাচ্ছেন কৃষকরা।
প্রসঙ্গত, ভোজ্যতেলের ৯০ ভাগ দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। দেশের উৎপাদিত ভোজ্যতেল দিয়ে মাত্র ১০ ভাগ চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। ৯০ ভাগ ভোজ্য তেল আমদানি করতে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়। সয়াবিন তেলের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সরিষা চাষের পরিধি বাড়াতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। সরকারি নানা সহায়তা ও প্রণোদনার কারণে কৃষক এখন সরিষা চাষে অধিক উৎসাহ পাচ্ছেন বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এনএস