যে কারণে ইয়েমেনে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য
১২ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:৪৬
বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধান রুটগুলোর একটি লোহিত সাগর। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এই রুট ব্যবহার করে গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে গার্মেন্টস পণ্য বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যায়। ইয়েমেন-ভিত্তিক হুথি বিদ্রোহীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফিলিস্তিনের হামাসকে সমর্থন জানাতে অক্টোবর থেকে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হামলা চালিয়ে আসছে। এতে বিশ্বের প্রধান বাণিজ্য রুটগুলোর একটি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
হুথি হামলার ভয়ে বিশ্বের ১০টি প্রধান কন্টেইনার শিপিং কোম্পানির ছয়টিই লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। সুয়েজ খাল ব্যবহার করে লোহিত সাগরে প্রবেশ বা প্রস্থান করে পণ্যবাহী জাহাজগুলো। সুয়েজ খাল দিয়ে বিশ্বের প্রায় ১৫ শতাংশ বাণিজ্য হয়ে থাকে। আর বৈশ্বিক কন্টেইনার চলাচলের ৩০ শতাংশ হয়ে থাকে সুয়েজ খাল ব্যবহার করে। বিশেষ করে তেল রফতানির জন্য সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর গুরুত্বপূর্ণ।
লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল লম্বা সময় বন্ধ থাকলে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় ধস নামবে। করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বে সরবরাহ শৃঙ্খল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে উঠেছে। লোহিত সাগরে অস্থিরতার কারণে সরবরাহ শৃঙ্খল অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেননা, জাহাজগুলোর রুট পরিবর্তন করলে খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এতে বিশ্বজুড়ে রকেটের গতিতে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ, লোহিত সাগরে সংকট যত বাড়বে, ততোই বাড়বে অর্থনৈতিক সংকট।
ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের চালান বিলম্বের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের খরচ বৃদ্ধির ব্যাপারেও তারা চিন্তিত। তেলের দামও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ইসরাইল-হামাস ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ কেন্দ্র করে একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার ওমান উপসাগরে ইরান একটি ট্যাঙ্কার আটক করার পর জ্বালানির বাজার দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে বৈশ্বিক বাণিজ্য কমেছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। বৃহস্পতিবার জার্মানির কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকোনোমি জানিয়েছে, লোহিত সাগরে কার্গো জাহাজে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে এই বাণিজ্য হ্রাস। মঙ্গলবার প্রকাশিত একটি দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, প্রধান এই শিপিং রুটে সৃষ্ট সংকটের কারণে সরবরাহ নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতিজনিত বাধার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সর্বশেষ, গত মঙ্গলবার লোহিত সাগরে কয়েকটি মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক জাহাজ। ওই বাণিজ্যিক জাহাজের বহরে হামলা চালায় হুথিরা। এসময় ২০টি ড্রোন ও তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করে মার্কিন সামরিক জাহাজটি। তবে হুথিদের হামলায় কয়েকটি বাণিজ্যিক জাহাজ প্রায় ডুবতে বসেছিল। এর মধ্যে অন্তত একটি জাহাজ জেট ফুয়েল বহন করছিল।
এ ঘটনার পর ওয়াশিংটন ও লন্ডন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। অন্যান্য মিত্রদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে ওয়াশিংটন। পরে বৃহস্পতিবার রাতে ইয়েমেনে বড় আকারের হামলা চালায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের শক্তি খর্ব করে লোহিত সাগরকে নিরাপদ রাখাই এই হামলার উদ্দেশ্য। হুথি বিদ্রোহীরা এই হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে।
ইয়েমেনে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ হামলায় মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইরান।
ইরান
শুক্রবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ফিলিস্তিনি জনগণ এবং গাজার অবরুদ্ধ নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী শাসকের যুদ্ধাপরাধের জন্য গত ১০০ দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমর্থন বৃদ্ধির চেষ্টায় এই হামলা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, এই হামলা ইয়েমেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
সৌদি আরব
গত প্রায় এক দশক ধরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে সৌদি আরব। বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংযম এবং সংঘাত কমানোর আহ্বান জানিয়েছে। সৌদি আরব জানিয়েছে, তারা উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, লোহিত সাগর অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার গুরুত্বের উপর জোর দেয় সৌদি আরব। কারণ নৌচলাচলের স্বাধীনতা একটি আন্তর্জাতিক দাবি।
তুরস্ক
ন্যাটো সদস্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান হামলার নিন্দা করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য লোহিত সাগরকে রক্তের সাগরে পরিণত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, এই সমস্ত কাজই শক্তির অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার। ইসরাইলও ফিলিস্তিনে শক্তির অসম ব্যবহার করছে।
মিশর
মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লোহিত সাগরে সামরিক অভিযান বৃদ্ধি এবং ইয়েমেনে বিমান হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা কমাতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টাকে একত্রিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ন্যাটো
যদিও সামরিক জোট হিসেবে ন্যাটো এই হামলায় এখনও যোগ দেয়নি, তবে অন্যতম দুই সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এতে জড়িয়েছে। তবে কিছু সদস্যের প্রতিবাদ সত্ত্বেও জোট হিসেবে ন্যাটো এই হামলায় সমর্থন জানিয়েছে। ন্যাটোর একজন মুখপাত্র বলেছেন, এই হামলাগুলো প্রতিরক্ষামূলক। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলোর মধ্যে একটিতে জাহাজ চলাচলে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। লোহিত সাগরে হুথিদের হামলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেছেন, হুথি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সমর্থন দিচ্ছে ইরান। তাই তেহরানের প্রক্সিদের লাগাম টেনে ধরার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
রাশিয়া
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, ইয়েমেনে মার্কিন বিমান হামলা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনের অ্যাংলো-স্যাক্সনদের বিকৃতির আরেকটি উদাহরণ। জাখারোভা বলেছেন, এই হামলাগুলি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলা প্রদর্শন। এই হামলা এ অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
হিজবুল্লাহ
ইরান ও হুথিদের অন্যতম মিত্র লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, মার্কিন আগ্রাসন নিশ্চিত করে যে, ফিলিস্তিনে বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের সঙ্গে পূর্ণ অংশীদারিত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজা এবং অঞ্চলে ইহুদিবাদী শত্রু দ্বারা সংঘটিত ট্র্যাজেডি এবং গণহত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে অংশীদার।
সারাবাংলা/আইই