‘স্বাস্থ্যখাত ঠিক করতে হলে চিকিৎসক সমাজকে ভালো রাখতে হবে’
১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:০০
এমবিবিএস পাস করার পর ১৯৭৫ সালে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে কর্মজীবন শুরু ডা. সামন্ত লাল সেনের। পরে ঢাকায় বদলি হয়ে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন তিনি। এর পর ১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি হন। ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা মেডিকেলে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম বার্ন ইউনিট চালু হয়। তিনি এই বিভাগ চালুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরে ২০০৩ সালে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জন্য স্বতন্ত্র একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি এ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। পরে সরকার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেন। এর পর এ ইউনিটটিকে স্বতন্ত্র একটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নামকরণ করা হয়। যেখানে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই থেকে চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। ডা. সামন্ত লাল সেন শুরুতেই এই ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পান। তার পর থেকে তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তবে হঠাৎ করেই তাকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। গত ১১ জানুয়ারি তিনি শপথ নেন। শপথের পর তাকে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১২ জানুয়ারি তিনি সারাবাংলার সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সৈকত ভৌমিকের সঙ্গে স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা কথা বলেন। সেই কথপোকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
সারাবাংলা: হঠাৎ করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এই খাতের অনেক সমস্যা আছে। সেইসব সমস্যা সমাধানে আপনার প্রথম পদক্ষেপ কী হবে?
ডা. সামন্ত লাল সেন: আসলে হঠাৎ করেই এমন দায়িত্ব। এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তবে দায়িত্ব যখন চলেই এসেছে তখন ভালোভাবেই পালন করতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, স্বাস্থ্যখাতকে ঠিক করতে হলে চিকিৎসক সমাজকে ভালো রাখতে হবে। আমি যদি ভালো না থাকি তবে ভালো সেবা দিতে পারব না। আমি যাকে দিয়ে কাজ করাব তাকে যদি শান্তিতে না রাখি তবে কাজ আদায় করব কিভাবে? সুতরাং এই জিনিসগুলো আগে দেখতে হবে।
সারাবাংলা: এক দশক পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব একজন চিকিৎসককে দেওয়া হলো। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে কাজ করতে চান আপনি।
ডা. সামন্ত লাল সেন: আমি প্রশাসনিক দায়িত্ব শুরুর পর বলতে পারব কোথায় কী করতে হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের চিকিৎসকরা খুবই দক্ষ ও আন্তরিক। চিকিৎসা জ্ঞান ও দক্ষতা সবই তাদের আছে। তাদের যদি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে দেশের যেকোনো হাসপাতালে ভালো সেবা পাওয়া যাবে।
সারাবাংলা: চিকিৎসার পরিবেশ ও চিকিৎসকদের সমস্যাগুলো আপনি জানেন। সেইসব সমস্যা সমাধানে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেবেন।
ডা. সামন্ত লাল সেন: চিকিৎসক সমাজের অনেকরকম কষ্টের কথা আমি শুনে থাকি। আমাদের তরুণ চিকিৎসকরা যখন বলেন, স্যার আমার প্রমোশন হয় না, আমার অমুক সমস্যা- তখন সেগুলো আসলে তাদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট সবাইকে হতাশ করে তোলে। আমি চেষ্টা করব প্রান্তিক পর্যায় থেকে কাজ করতে। চেষ্টা করব চিকিৎসকদের একটা ভালো পরিবেশ দেওয়ার। তারা যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারেন। তাতে দেশের মানুষ ভালো সেবা পাবেন।
সারাবাংলা: বাংলাদেশের চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী।
ডা. সামন্ত লাল সেন: বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অনেক গুণ আছে। অনেক ভালো ভালো কাজ আছে। জোড়া মাথার বাচ্চার অস্ত্রোপচারসহ আরও অনেক ভালো ভালো উদাহরণ আছে। সুতরাং, আমি যদি চিকিৎসকদের ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি তারা বিশ্বমানের যেকোনো কাজ করতে পারবে।
সারাবাংলা: দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে চিকিৎসাসেবা খাতে কোন ধরণের পরিবর্তন আনতে চান?
ডা. সামন্ত লাল সেন: অবশ্যই আমার এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা আছে। চেষ্টা করব চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার। আমি সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। আমি শুধু ঢাকা শহর নিয়ে ব্যস্ত থাকব বিষয়টা তেমন হবে না। আমি একসময় সারাদেশ ঘুরেছি। তাই আমি জানি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কোথায় মানুষের কী কষ্ট, কোথায় কী অবস্থা। আমি যদি তৃণমূলে একটা ভালো হাসপাতাল নিশ্চিত করতে পারি তবে নিশ্চিতভাবে আমার চিকিৎসকরা সেখানে ভালো কাজ করতে পারবে।
সারাবাংলা: এখনও সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে নানা ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। মানুষের জীবনমান উন্নত হলেও এখনও অনেক জায়গায় চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন হয়নি। সেগুলো নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
ডা. সামন্ত লাল সেন: আমি একসময় বানিয়াচং কাজ করতাম। তখন নৌকায় যেতে হতো। এখন তো সেই সময় নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে, প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন। এখন আমাদের দেখতে হবে প্রত্যেকটা মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতাল। আমি কিন্তু অনেক স্থানে ঘুরেছি এর আগে। রোগীদের মাটিতে শুয়ে থাকাসহ আরও নানা বিষয় দেখেছি। আমি এগুলো সমাধানের চেষ্টা করব। সাধারণ মানুষ যেন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাটা পৌঁছে দেওয়া যায় সেই লক্ষ্যেই আমি কাজ করব। আমি আগে যোগদান করি। তখন আমি আরও ভালো বলতে পারব। কোথায় কোথায় কী কী ফাঁক আছে, আর কোথায় কোথায় কাজ করতে হবে।
সারাবাংলা: স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে নানা রকমের আলোচনা ও সমালোচনা হয়ে থাকে। দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না?
ডা. সামন্ত লাল সেন: এখানে যে দুর্নীতি হয় তা আপনারা বলছেন আর আমি শুনছি। তবে দুর্নীতি কোথায় হয়, আর কীভাবে হয় তা আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে। অবশ্যই আমি চাইব না দুর্নীতি হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশাল আস্থা নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অনেক লোকের মাঝে তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন। সুতরাং উনারও একটা প্রত্যাশা আছে। উনার সেই প্রত্যাশা যেভাবেই হোক পূরণের চেষ্টা করব। দুর্নীতি বন্ধ করা তাই অবশ্যই একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি।
সারাবাংলা: রেফারেল সিস্টেম নিয়ে কোনো অগ্রগতি থাকবে কিনা?
ডা. সামন্ত লাল সেন: এখনই আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আগে জেনে নিই কতটুকু কী আছে বা হয়েছে। তারপর আমি জানাতে পারব। আমাকে মাত্র সিলেক্ট করা হয়েছে। সুতরাং আমি সবার কাছে সহযোগিতার অনুরোধ করব।
সারাবাংলা: অনেক হাসপাতালেই নতুন কেনা যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা খাতে রয়েছে নানান সমস্যা। এর মাঝে চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় জনবল সংকট মোকাবিলা করে রোগীদের বিদেশমুখী চিকিৎসাসেবা নেওয়ার হার কমাতে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না?
ডা. সামন্ত লাল সেন: এসব বিষয় অবশ্যই দেখতে হবে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। কিছুদিন আগে ১৪ সদস্যদের একটা টিম নিয়ে ভুটান যাই। সেখানে আমরা ১৮টা অপারেশন করে আসি। বর্তমানে ভুটান থেকে একজন রোগী বাংলাদেশে এসেছেন। আমরা কিছুদিন আগে তার অপারেশন করেছি। এটা কিন্তু সরকারিভাবে বিদেশি কোনো রোগীর বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নেওয়ার প্রথম ঘটনা। এ বিষয়টি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি ভুটানের প্রধানমন্ত্রীও জানেন। আমি চেষ্টা করছি আমাদের চিকিৎসার মান উন্নয়ন করতে। আমি চাইব না কোনো ধরণের অপচয় হোক। তাই যন্ত্রপাতি যেন অকেজো পড়ে না থাকে সেসব বিষয়ে নজর দেব।
সারাবাংলা: সামনের দিনগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কোনো সমস্যা দেখছেন কি না?
ডা. সামন্ত লাল সেন: চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তবে আমার পক্ষে তো আর একা সব সামলানো সম্ভব নয়। আমার চিকিৎসক সমাজ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বিশাল বড় সাপোর্ট দরকার। সবাই মিলে যদি সুন্দরভাবে কাজ করতে পারি তবে সফলতা আনা কঠিন হবে না। আমি যদি পাঁচ বেড থেকে ৫০০ বেড বানাতে পারি তাহলে কেন এই মন্ত্রণালয়ে সফল হতে পারব না?
সারাবাংলা: আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে কোন বিষয়টিকে বেশি প্রধান্য দিতে চান।
ডা. সামন্ত লাল সেন: কর্মজীবনের শুরু থেকেই মানুষের জন্য কাজ করেছি। বার্ন ইউনিট থেকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নিয়েছি। দেশের অন্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ন ইউনিট ও আরও ইনস্টিউটের কাজ বাকি আছে, সেগুলো করতে হবে। শেখ কামাল আমার বন্ধু ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানাই। আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই অশেষ শ্রদ্ধা। আগে যা ছিলাম আমি তাই থাকব। মানুষের জন্য কাজ করব।
সারাবাংলা: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী হিসেবে আপনার পথচলা শুভ হোক। সারাবাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ডা. সামন্ত লাল সেন: আপনাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম