Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জোসেফ-হার্টলি জাদু ও টেস্টের আশার প্রদীপ

ফাহিম মাশরুর
২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:৪৮

জোসেফ-হার্টলি নতুনভাবে প্রাণ ফিরিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে

চার ইনিংস, ৪৫০ ওভারের লড়াই, সকাল থেকে সন্ধ্যা, টানা পাঁচ দিন। ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে আধুনিক বিশ্বে ছুটছে মানুষ। ব্যস্ত মানুষের এই ‘ম্যাড়ম্যাড়ে’, ‘দীর্ঘ’ ফরম্যাটের কচ্ছপ গতির খেলা দেখার সময়টা কোথায়? বাড়ছে ব্যস্ততা, কমছে সময়। কম সময়ে চার-ছক্কার বন্যা বয়ে যাওয়া ‘হট অ্যান্ড হ্যাপেনিং’ ক্রিকেট ছাড়া কি খেলা জমে? এতেই জনপ্রিয়তার পারদ তরতর করে বাড়ছে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের, কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ক্রিকেটের আদি সংস্করণ। চারপাশ থেকে গুঞ্জন, টেস্ট ক্রিকেট কি তাহলে হারিয়েই যাবে কালের অতল গহ্বরে? কিন্তু যতবারই উঠেছে এই প্রশ্ন, ততবারই টেস্ট ক্রিকেট জানান দিয়েছে, সে হারিয়ে যাওয়ার জন্য আসেনি! অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে শামার জোসেফের সেই পাগলাটে দৌড় কিংবা ভারতের বিপক্ষে টম হার্টলির বাঁ হাতের ম্যাজিক, টেস্ট ক্রিকেট আবারও প্রমাণ করেছে, সে টিকে থাকবে অনন্তকাল।

আরও পড়ুন- দ্যা কিউরিয়াস কেস অফ নাসির 

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট: টেস্ট ক্রিকেটের প্রাণঘাতী ‘ক্যানসার’?

দেড়শ বছর ধরে দাপটের সাথেই রাজত্ব করছিল ক্রিকেটের ‘শুদ্ধতম’ সংস্করণ। মাঝে ওয়ানডে ক্রিকেটের আবির্ভাব হলেও সেটা কখনোই টেস্টের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ২০০০ সালের পর এমন এক ফরম্যাটের আবির্ভাব ঘটে ক্রিকেট বিশ্বে, যা টেস্টের ভিতকে নাড়িয়ে দেয়। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ২০ ওভারের ক্রিকেট আয়োজন করে ইংলিশ কাউন্টি লিগ। ২০০৪ সালের ৫ আগস্ট প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড নারী দল। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো এই ফরম্যাটে মাঠে নামে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড পুরুষ দল।

‘পিকনিক’ ক্রিকেট হিসাবে মোটামুটি জনপ্রিয় হয়েছিল এই ফরম্যাট। তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের পর। ক্লাসিক ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ধোনির ভারত। উল্লাসে মাতোয়ারা ভারতীয়দের জন্য বিসিসিআই নিয়ে আসে আইপিএল নামের ‘সোনার ডিম পাড়া’ ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ। সেই শুরু, এরপর টি-টোয়েন্টি লিগ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে।

২০ ওভারের খেলা কমতে কমতে এখন থেকেছে ৫ ওভারের টুর্নামেন্টেও! ৫ দিনের দীর্ঘ ক্রিকেট ম্যাচের চেয়ে ২-৩ ঘণ্টার জমজমাট লড়াই নজর কেড়েছে সবার। ছেলে থেকে বুড়ো, সবাই মাতোয়ারা এই ফরম্যাটেই। এর প্রভাবটা বেশ ভালোমতোই পড়েছে টেস্টে, কমেছে ম্যাচ, কমেছে দর্শক, কমেছে স্পন্সর, কমেছে উন্মাদনাও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তাই নিরব ঘাতকের মতোই তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটকে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ যখন টেস্টের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ

আইপিএলের পর বিভিন্ন দেশেই আয়োজন করা হয়েছে টি-টোয়েন্টি লিগের। জমকালো আয়োজন, নামীদামী কোম্পানির মোটা অংকের স্পন্সরশীপ, টাকার ঝনঝনানি; তরুণ থেকে বুড়ো সবাই আকৃষ্ট হচ্ছেন এসবেই। একটা সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ‘অবসর’ সময়ে আয়োজন করা হলেও গত কয়েক বছরে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ চলার সময়েই রাখা হচ্ছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের সূচি। আর এতেই বেঁধেছে বিপত্তি। লিগ না জাতীয় দল, কোনটিকে বেছে নেবেন ক্রিকেটাররা? এই দ্বিধাতেই অনেকে নিচ্ছেন কঠিন সিদ্ধান্ত। টেস্টে বিশ্রাম নিয়ে খেলছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে। বোর্ডের সাথে এই ইস্যুতে ঝামেলাতেও জড়িয়েছেন অনেকেই। এই ঝামেলা এড়াতে অনেক ক্রিকেটার টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছেন!

এতদিন তো শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে টেস্ট ক্রিকেটে অনীহার দেখা মিলেছিল। এবার সেটা পৌঁছে গেছে বোর্ড পর্যায়েও। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড সফরে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিশ্বাস্য এক আনকোড়া একাদশ টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে সবাইকে। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগের সাথে সাংঘর্ষিক সূচি হওয়ায় মূল দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটারকেই নিউজিল্যান্ড সফরে পাঠায়নি দক্ষিণ আফ্রিকা। অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা ৭ ক্রিকেটারসহ ইতিহাসের সবচেয়ে অনভিজ্ঞ স্কোয়াডকে টেস্ট খেলতে পাঠিয়েছে প্রোটিয়া বোর্ড। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে সরল স্বীকারোক্তি, ক্রিকেটাররা টেস্টের চেয়ে টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতেই বেশি আগ্রহী।

জাতীয় দলের এমন স্বীকারোক্তি স্বভাবতই প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে কি ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে বোর্ডগুলো? শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের কারণেই টেস্টের পরিবর্তে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে বেশি মনোযোগ দেবেন ক্রিকেটাররা?

আইসিইউতে টেস্ট ক্রিকেট: রক্ষাকর্তা হবেন কে? 

আইপিএলসহ বিশ্বজুড়ে আয়োজিত টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের সাথে গত কয়েক বছরে যোগ হয়েছে আবু ধাবির টি-টেন লিগ। যুক্তরাষ্ট্র, হংকংসহ অনেক দেশেই দেখা মিলেছে টি-ফাইভ লিগেরও! অনেকে তো মজা করে বলছেন, কয়েক বছরের মাঝে ক্রিকেট ম্যাচ আর মাঠেই গড়াবে না, শুধু টসের মাধ্যমেই নির্ধারণ করা হবে ফলাফল! আদতে অবাস্তব মনে হলেও ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ এমন পর্যায়ে গেলে খুব অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, বাংলাদেশ ছাড়া টেস্ট ম্যাচে খাঁ খাঁ করছে গ্যালারি। নেই কোনও উত্তাপ, নেই উন্মাদনা। টেস্ট সিরিজ আয়োজনের চেয়ে তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে অন্য দেশগুলো। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে তাই টেস্টের চেয়ে বাড়ছে টি-টোয়েন্টির সংখ্যা। প্রথা ভেঙ্গে ৪ দিনের টেস্ট আয়োজনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে বহুবার। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে তো সময়ের কারণে বহুকাল আগে থেকেই টেস্ট ক্রিকেট বাতিলের খাতায়। ক্রিকেট তাই খুব বেশি ছড়াতেও পারেনি ওইসব অঞ্চলে। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের সুবাদেই সেইসব অঞ্চলে যা একটু পরিচিতি পাচ্ছে ক্রিকেট।

অবস্থা যখন এমন, তখন প্রশ্ন একটাই। টেস্ট কি তাহলে সত্যিই মরে যাবে? আইসিসইউতে ‘লাইফ সাপোর্টে’ থাকা টেস্ট ক্রিকেটের রক্ষাকর্তাই বা হবেন কারা?

অভিষেকেই জোসেফ-হার্টলি জাদু ও টেস্টের আশার প্রদীপ

টেস্ট ক্রিকেট যখন লাইফ সাপোর্টে, তখন তাকে বাঁচানোর দায়িত্ব তো কাউকে নিতেই হবে। সেই দায়িত্বটা যে নিজের প্রথম টেস্ট সিরিজ খেলতে নামা দুই তরুণ নেবেন, সেটা কে ভেবেছিল? একদিকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের কারণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার শামার জোসেফ, অন্যদিকে ইংল্যান্ডের বাঁহাতি স্পিনার টম হার্টলি। দুই তরুণ নিজেদের অভিষেক সিরিজে নেমেছিলেন দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে, তাও আবার তাদের মাটিতেই।

প্রথম টেস্টে বাজেভাবে হারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরা হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, হোয়াইটওয়াশ হয়েই দেশে ফিরতে হবে তারুণ্যনির্ভর দলকে। ম্যাচের চতুর্থ দিনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত জয়ের পথেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু জোসেফের উপর কাল ব্রিসবেনে ভর করেছিল ক্যারিবিয়ান পেসারদের স্বর্ণযুগের অতীত। অজি ব্যাটিং লাইনআপকে তাসের ঘরের মতো চুরমার করে জোসেফ একাই নিয়েছেন সাত উইকেট। অবিশ্বাস্যভাবে ৮ রানের এক জয়ে সিরিজে সমতা আনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দীর্ঘ ২৭ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয় আবেগে ভাসিয়েছে ব্রায়ান লারা, ইয়ান বিশপ, কার্ল হুপারসহ কিংবদন্তী ক্যারিবিয়ান সাবেক ক্রিকেটারদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা ২০ টেস্ট পর জয়ের স্বাদ পেয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

নিয়তির কি খেলা। জোসেফের এই কীর্তির কিছু সময় পরেই হাজার মাইল দূরে ভারতের মাটিতে অবিশ্বাস্য এক জয় পেয়েছে ইংল্যান্ডও। জয়ের নায়ক অভিষেক হওয়া হার্টলি। প্রথম ইনিংসে বাজে বোলিং করলেও দ্বিতীয় ইনিংসে তার ঘূর্ণিজাদুতেই কুপোকাত ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। প্রথম ইনিংসে ১৯০ রানে পিছিয়ে থেকেও ২৮ রানের জয় পেয়েছে ইংলিশরা। কাকতালীয়ভাবে জোসেফের মতো দ্বিতীয় ইনিংসে হার্টলিও পেয়েছেন ৭ উইকেট! ঘরের মাঠে এমন এগিয়ে থেকেও ইংল্যান্ডের কাছে হার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ভারতের সমর্থকরা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ডের এই জয় শুধুই কি জয়? নাকি জোসেফ, হার্টলির বীরত্ব ক্রিকেট বিশ্বকে আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, টেস্ট ক্রিকেটের যে উত্তেজনা, সেটাকে ছুঁতে পারবে না অন্য কোনও ফরম্যাটই। পিছিয়ে পরেও অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে আসা, অকল্পনীয় জয়ের সব গল্প, বোলিং-ব্যাটিংয়ের সমানে সমানে লড়াই; টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্যকে নতুনভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছেন জোসেফ-হার্টলি।

অবিস্মরণীয় এক জয়ের পর জোসেফ বলেছেন, যতই টাকার হাতছানি আসুক, নিয়মিত টেস্ট ক্রিকেট খেলাই তার প্রথম লক্ষ্য। হার্টলিও টেস্টেই নিজেকে মেলে ধরার ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দেবেন বলেই জানিয়েছেন। ধুঁকতে থাকা টেস্ট ক্রিকেটকে কি বাঁচাতে পারবেন জোসেফ-হার্টলিদের মতো তরুণরা? দেড়শ বছর আগে মেলবোর্নে টেস্ট ম্যাচের যে যাত্রা, সেই যাত্রা কি থেমে যাবে হালের জাঁকজমকপূর্ণ ‘অক্রিকেটীয়’ ও ‘ব্যবসায়ী’ ক্রিকেটের কাছে? নাকি ফিনিক্স পাখির মতো বারবারই জেগে উঠে স্বমহিমায় টিকে থাকবে টেস্ট?

সারাবাংলা/এফএম

অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট জোসেফ টপ নিউজ টেস্ট ভারত হার্টলি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর