বিজ্ঞাপন

দ্যা কিউরিয়াস কেস অব নাসির

January 17, 2024 | 4:24 pm

ফাহিম মাশরুর

কবি জীবনানন্দ দাশ বহুকাল আগেই বলেছিলেন, নক্ষত্রেরও নাকি মরে যেতে হয়! বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্রযাত্রায় নক্ষত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন অনেকেই, হারিয়ে যাওয়ার সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়। নক্ষত্রর পতনের এই হতাশার কাব্যে যার নামটা বারবার ঘুরে ফিরে আসবে, তিনি অলরাউন্ডার নাসির হোসেন। অভিষেকের পর যে নাসির হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাণ্ডারি, সেই নাসিরই নানা বিতর্কে হারিয়ে গিয়েছেন কালের অতল গহ্বরে। কিন্তু নাসিরের এই যে হারিয়ে যাওয়া, এর দায় কার? দায়ী কি শুধু নাসির নিজেই?

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- নাসিরকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে আইসিসি 

এলেন, দেখলেন, জয় করলেন দ্যা ফিনিশার

বাংলাদেশের ক্রিকেটে ২০১১ সালে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ১৯ বছরের এক লিকলিকে তরুণের। যে বাংলাদেশ বরাবরই হা-হুতাশ করেছে একজন ‘ফিনিশারের’, অনেকটা জাদুবলেই যেন সেই ফিনিশারকে পেয়ে গেল দল। সে সময়ে নাসির হোসেন যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন!

বিজ্ঞাপন

ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে একই বছরে অভিষেক হয়েছিল নাসিরের। সেসময় ব্যাটে-বলে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স নজর কাড়ে সবার। ব্যাটিং অর্ডারে সাতে নেমে নাসিরের আগ্রাসী ব্যাটিং দলকে হামেশাই এনে দিত লড়াই করার স্কোর। কখনও রান তাড়া করতে নেমে ফিনিশার হিসেবে এনে দিয়েছেন দারুণ কিছু জয়। ব্রেক থ্রু দরকার? নাসিরের ডানহাতি অফ স্পিনেই সমাধান খুঁজেছেন দলের অধিনায়ক। তবে নাসিরের সবচেয়ে বড় ‘এক্স ফ্যাক্টর’ ছিল চোখ ধাঁধানো ফিল্ডিং। সবকিছু মিলিয়ে যেন নাসিরের মাঝেই আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমী।

নারীতেই ডুবলেন নাসির?

অভিষেকের পর প্রথম সাত বছর ভালোই কেটেছে ক্রিকেটার নাসির হোসেনের। মাঝে ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পেছনে নাসিরের ভূমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য। তবে ২০১৮ সালের পরে ধীরে ধীরে ক্রিকেটের চেয়ে মাঠের বাইরের জীবনে বেশি মনযোগী হয়ে ওঠেন নাসির। আর সেই মনযোগই কাল হয়েছিল তার। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মিরপুরে শ্রীলংকার বিপক্ষে খেলা ওয়ানডে তাই এখনও তার ক্যারিয়ারের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

ঘরোয়া লিগে নাসিরের আচরণ নিয়ে আগে থেকেই বেশ বিতর্ক ছিল। মাঠে ও মাঠের বাইরে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য ধীরে ধীরে জাতীয় দলেও ব্রাত্য হয়ে ওঠেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, বিসিবি সভাপতি নিজেই বলেন- জাতীয় দলে নাসিরের জন্যে আর জায়গা নেই।

জাতীয় দলে ব্রাত্য হওয়ার সময়টাতেই নাসিরের জীবনে মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে আসে নারী কেলেঙ্কারি। হঠাৎ করে সুবহা নামের এক মডেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেন, নাসির তার বহুদিনের প্রেমিক! সুবহার ভিডিও ফুটেজটি ভাইরাল হওয়ার পর বের হয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, নাসিরের সাথে অনেকসময় ধরেই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক চলছিল সুবহার। নাসিরও এই সম্পর্কের খবরে তেমন কোনও জোরালো প্রতিবাদ করেননি।

Court grants bail to cricketer Nasir, wife Tamima

সুবহা-নাসির বিতর্ক বেশ কয়েকমাস ধরে ছিল মানুষের মুখে মুখে। সেই বিতর্ক শেষ না হতেই ২০২১ সালে আবারও নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়ান নাসির। সেই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে ঘটা করে ঢাকার এক রেঁস্তোরাতে বিমানের কেবিন ক্রু তামিমা তাম্মিকে বিয়ে করেন নাসির। সবাই ভেবেছিলেন, এবার বুঝি থিতু হলেন নাসির।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু ঘটনার শুরু সেখানেই। বিয়ের একদিন না পেরুতেই জানা যায়- তাম্মির এটি দ্বিতীয় বিয়ে, আছে ৮ বছরের মেয়েও! তাম্মির প্রথম স্বামী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি বোমা ফাটান। তিনি জানান, তালাক না নিয়েই নাসিরকে বিয়ে করেছেন তাম্মি! প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে এই ভুল স্বীকার করে নেন নাসির-তাম্মি দুজনই।

আইফোনের লোভে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায়!

একের পর এক নারী কেলেঙ্কারিতে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন বহু আগে শেষ হয়েছে নাসিরের। ঘরোয়া ক্রিকেট ও গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগে খেলে দিন কাটছিল তার। সাম্প্রতিক সময়ে ঘরোয়া লিগে যে খুব একটা খারাপ খেলেছেন তা কিন্তু নয়। সবশেষ বিপিএলে দারুণ পারফর্ম করে ক্রিকেট ভক্তদের হাহাকারটা আরও বাড়িয়েছিলেন কেবল। তবে দুবাই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে গিয়ে বাঁধিয়েছেন বিপত্তি। গত সেপ্টেম্বরে নাসিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে আইসিসি। আইসিসি জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ২০২১ সালের টি-১০ লিগে দুর্নীতি করার চেষ্টা করেছিলেন নাসির।

দুর্নীতির বিস্তারিত জানতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। জানা যায়, জুয়াড়ির কাছ থেকে ১২ মডেলের আইফোন ‘উপহার’ নিয়েছিলেন নাসির। এবং নিয়মমতো এই উপহারের ব্যাপারে আইসিসিকে কিছুই জানাননি তিনি। অনুসন্ধানের সময় এই ফোনের কোনও রিসিটও দেখাতে পারেননি নাসির। আর এতেই কপাল পুড়েছে নাসিরের। আইসিসির তিনটি কোড অফ কন্ডাক্ট ভঙ্গ করায় ২ বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নাসিরকে নিষিদ্ধ করেছে আইসিসি।

Bangladesh all-rounder Nasir Hossain handed two-year suspension by ICC for breaching Anti-Corruption Code

 

দায় কি কেবল নাসিরেরই?

গত দেড়যুগে তরতর করে এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। মাঠের পারফরম্যান্সে আলো ছড়ানোর পাশাপাশি বেড়েছে মাঠের বাইরের কর্মকাণ্ডও। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সরব দেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটার। আর নেট দুনিয়ায় এই ‘ভাইরাল’ হতে গিয়ে বারবারই অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। শুধু মাঠের বাইরে নয়, খেলার মাঠেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ক্রিকেটারদের। কখনও সতীর্থ, কখনওবা দর্শক, কখনও আম্পায়ার- ক্রিকেটারদের চড়া মেজাজের শিকার হতে হয়েছে অনেককেই।

মাঠের বাইরের কেলেঙ্কারির মধ্যে সবচাইতে আলোচিত ঘটনাগুলো নারীঘটিত বা জুয়াড়িদের সঙ্গে সম্পর্কিত। বোলার রুবেলের সেই ‘হ্যাপি কান্ড’ কিংবা নাসিরের ‘সুবহা-তাম্মি বিতর্ক’ এখনও লোকের মনে আছে। ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিতর্কিত ঘটনা প্রভাব ফেলেছে তাদের ক্যারিয়ারেও। রুবেল সেই ঘটনা থেকে বের হয়ে আসলেও নাসিরের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের ইতি ঘটেছে মূলত নারী কেলেঙ্কারিতেই।

এদিকে গত এক দশকে ক্রিকেটের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে জুয়াড়িদের উৎপাত। আইসিসি কঠোর আইন করেও থামাতে পারছে না জুয়াড়িদের। আর তাই জুয়াড়িদের কোনো প্রস্তাব পেলে সাথে সাথেই আইসিসিকে জানানোর কঠোর নিয়মও করা হয়েছে। তবে অনেক দেশের ক্রিকেটারদের মতো বাংলাদেশেও এই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন অনেকেই। জুয়াড়ির প্রস্তাব লুকিয়ে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান তো নিষেধাজ্ঞাও পেয়েছিলেন। সাকিবের মতো এবার নিষিদ্ধ হয়েছেন ক্রিকেটার নাসির হোসেনও।

কিন্তু এই যে মাঠের বাইরের কেলেঙ্কারি এবং নিষিদ্ধ হওয়া- এর দায়ভার কি শুধু সাকিব-নাসিরদের একারই? খেলোয়াড়দের বিভিন্ন অপকর্মের শাস্তি দেওয়া ছাড়া ক্রিকেটারদের রক্ষা করতে তাদের অভিভাবক হিসেবে বিসিবির কোনও পদক্ষেপ এতবছরেও দেখা মেলেনি। তরুণ ক্রিকেটারদের একদম ছোটবেলা থেকেই মাঠ ও মাঠের বাইরের জীবন নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, গ্রুমিং করানোর দাবিটা বহুদিনের। গ্রুমিং নেই বলেই হয়তো রুবেল, সাকিবদের পুরোনো ভুলটা নতুন করে করলেন নাসির।

ক্রিকেট খেলুড়ে অন্য দেশগুলোতে তরুণ ক্রিকেটারদের যেভাবে গ্রুমিং করিয়ে জাতীয় দলের জন্য প্রস্তুত করা হয়, দীর্ঘসময় পেরিয়ে গেলেও আমাদের তেমন কোনও প্ল্যাটফর্ম গড়েই ওঠেনি। আর এ কারণেই ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পা দিয়ে কিছু সাফল্য পাওয়ার পরই পা হড়কান। মাঠের বাইরের ঝলমলে জীবনের হাতছানি তাদের টেনে নেয় বিতর্কের পথে। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ওঁত পেতে থাকা জুয়াড়িরা নানা প্রলোভনে ফাঁসিয়ে ধ্বংস করে উঠতি তারকাদের ক্যারিয়ার।

ক্রিকেটাররা শিখতে পারেন নাসিরের কাছে

রুবেল হোসেন ও সাকিব আল হাসানদের কাছ থেকে শিক্ষা নেননি নাসির হোসেন। নারী কেলেঙ্কারি ও ফিক্সিংয়ে সহায়তা- দুই বিতর্কেই জড়িয়েছেন নিজেকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে এখন তরুণদের জয়জয়কার। ‘পঞ্চপান্ডব’ ছাড়াই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষের সিরিজে শান্তর নেতৃত্বে বাংলাদেশের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স যেন দেখাচ্ছে নতুন আশার আলো। যেখানে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হাতছানি দেয়, সেখানেই থাকে বিতর্কের শঙ্কাও। জাতীয় দলের শান্ত-হৃদয়-শরিফুল কিংবা যুব দলের রাব্বি-শিবলীদের সেই মাঠের বাইরের বিতর্ক থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কী কোনও পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড? নাকি সাফল্যের আনন্দে ভাসানোর পর আবারও হঠাৎ বাংলাদেশের আশার প্রদীপকে ঘিরে ধরবে নতুন কোনও বিতর্কের অন্ধকার?

লেখকঃ ক্রীড়া সাংবাদিক

সারাবাংলা/এফএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন