‘বই কেনা হচ্ছে কিন্তু পড়া হচ্ছে কি না সংশয় আছে’
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:২৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বইমেলায় গিয়ে বই কিনলেও সেটি পড়া হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি বইমেলা খুব জমে ওঠে। বিশেষ করে ঢাকার বাংলা একাডেমির মেলা খুব জমজমাট হয়। প্রতি বছরই দেখছি, বিক্রির হার বাড়ছে। একসময় ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হতো। শুনেছি, এবার বিক্রি ২০০ কোটিতে পৌঁছাবে। বই কেনা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বই পড়া হচ্ছে কি না— এ বিষয়ে সংশয় আছে। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন ও ভালোবাসা ছাড়া মানুষ কাজ করে না। বইয়ের প্রতি সেই প্রয়োজনীয়তা বা ভালোবাসা আমরা গড়তে পারিনি।’
মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে অমর একুশে বইমেলা মঞ্চে আয়োজিত কবিতা উৎসবে আবুল মোমেন এ মন্তব্য করেন।
শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আবুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে মেগা প্রকল্প হয়েছে। এবার শিক্ষায় মেগা প্রকল্প হাতে নিতে হবে। ইউনেসকোর চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষায় জিডিপির ছয় শতাংশ বরাদ্দ হওয়ার কথা। আমরা সেই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু আমরা দুই শতাংশেও পৌঁছাতে পারিনি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমরাই সর্বনিম্ন, যেখানে শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ হয় খুব কম। সে জায়গাটা বাড়াতে হবে, যেন আগামী দিনে আমাদের সন্তানেরা বই পড়তে অভ্যস্ত হয়।’
সমাজে জ্ঞানের চাহিদা না থাকলে বইয়ের কদর হবে না মন্তব্য করে এই কবি বলেন, ‘বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থা বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করে না। বরং এতদিন ধরে পরীক্ষার চাপ এতটা বেশি ছিল যে তাতে বই বিমূখুতা তৈরি হয়। আবার মুখস্থবিদ্যানির্ভর লেখাপড়ার কারণে জ্ঞানের চাহিদাও তৈরি হয় না। যে সমাজে জ্ঞানের চাহিদা নেই, সে সমাজে জ্ঞানচর্চার যে মূল মাধ্যম বই, তার কদরও বেশি হবে না।’
এতদিন ধরে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে আবুল মোমেন আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা তো বইয়ের প্রয়োজন দাঁড় করায়নি। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবুক ও কোচিংকে বেশি গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে। এখানে লেখাপড়া করার চেয়ে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করাই বুদ্ধিমানের কাজ, স্কুলে যাওয়ার চেয়ে কোচিং সেন্টারে যাওয়াটা ফল বেশি দেয়।’
‘ফলে বইয়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ প্রক্রিয়াটি চলে এসেছে প্রথম শ্রেণি থেকে। তাই আমরা ক্লাসে গিয়ে দেখি, বই পড়ার সংখ্যা খুব কম। বই না পড়ে হয়তো মানুষ ডিগ্রি পাবে, চাকরি পাবে। কিন্তু সেই মানুষটি সংস্কৃতিমনা হবে না। নান্দনিক ও মননশীল হবে না,’— বলেন আবুল মোমেন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত এ কবি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হওয়ার ফলে বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পেয়েছি। বাঙালি জাতি হিসেবে একটি শাসিত রাষ্ট্র পেয়েছি। এমন নজির ইতিহাসে প্রথম। আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে পেরেছি ভাষার জোরে। পাকিস্তানে চারটি প্রদেশ আছে। বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখোয়া। তাদেরও নিজেদের ভাষা আছে। কিন্তু তাদের কথা বলতে হয় উর্দুতে। তারা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের দাবি তুলতে পারেনি। কারণ তাদের ইতিহাস ও সাহিত্য দুর্বল।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ ভাষাকে ভালোবাসবে তার সাহিত্য দিয়ে। শিল্প-সাহিত্য ছাড়া উন্নত মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব না। সাহিত্যপাঠ একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। কিন্তু এখন বিদ্যাপীঠগুলোতে সাহিত্যপাঠ হচ্ছে না। অনার্স ও মাস্টার্সপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সাহিত্য বা মূলপাঠ না পড়েই পাস করছে, ডিগ্রি অর্জন করছে। মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জাতি কখনো উন্নত হয় না।’
বাঙালির ভাষার প্রতি ভালোবাসা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে কবি আবুল মোমেন বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একুশ ও বইমেলা নিয়ে আবেগ ও উচ্ছ্বাস দেখা যায়। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা শহিদদের নাম তারা বলতে পারে না। কারণ ভাষার প্রতি ভালোবাসা কম। ভালোবাসা খাঁটি না। এ সংকট একদিনে তৈরি হয়নি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘যে মানুষ বই পড়ে না সে আজম্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে। মানুষকে দাবায়ে রাখতে না পারার অস্ত্র হচ্ছে বই। কিন্তু এখন বই পড়ার মানুষ কম। বই নিয়ে কথা শোনার মানুষ কম।’
‘বই না পড়লে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে জানব কীভাবে? একুশকে ধারণ না করা মানে বাঙালি সত্তাকে ধারণ না করা। কারণ একজন মানুষ যদি তার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সত্তা ভুলে যায়, তাহলে তাকে অন্য কোনো সত্তা আকৃষ্ট করতে পারে না। বই, একুশ, একাত্তর, নব্বই না জেনে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়া যাবে না,’— বলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য।
আবৃত্তিকার রাশেদ হাসানের সভাপতিত্বে কবিতা উৎসবে আরও বক্তব্য দেন কবি ফাউজুল কবির ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক।
সারাবাংলা/আইসি/একে