‘কারও জীবন যেন ছোট্ট মিমের মতো না হয়’
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:১৯
কক্সবাজার: ছোট্ট মিমের বয়স মাত্র ১০ মাস। আহত অবস্থায় মিমকে কোলে নিয়ে তার বাবা শুক্কুর হাজির হয়েছিল শহরের শহিদ স্মরণীর এক স্থানীয় পত্রিকা (দৈনিক কক্সবাজার) অফিসের সামনে। শিশুটির বাম হাত কনুই থেকে ভেঙে অস্বাভাবিকভাবে ঝুলছিল। রক্ত যাচ্ছিল কানের পাশ দিয়ে। কন্যা সন্তানকে কোলে নেওয়া অস্থির বাবা শুক্কুরের অভিযোগ ছিনতাইয়ের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মারামারিতে মিম’কে তারা আছাড় মেরে আহত করে। শুক্কুরের হাতেও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। আহত মিম’কে দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে মিম সুস্থ হয়ে উঠলেও হাতে ব্যান্ডেস রয়ে যায়। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়!
খবর নিয়ে জানা যায়, মিম, মুন্নী নামে এক যৌনকর্মীর সন্তান। তার মা টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুরাতন রোহিঙ্গা। বাবা শুক্কুর হলেন যৌনকর্মীদের দালাল। এছাড়া তিনি ছিনতাই, মাদকসেবন, পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। শুক্কুর ও তার স্ত্রী মুন্নীর মধ্যে বিরোধ হওয়ায় মেয়েকে রেখে মা চলে গেছেন অন্যখানে। মিমের দেখাশোনার দায়িত্ব থাকে অন্য যৌনকর্মীরা।
এরমধ্যে মিম হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় তার বিষয়ে সবকিছু জানতে পারেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সামনে থাকা রেস্টুরেন্টের আয়া। ওই নারীর ৭ সন্তানের মধ্যে সবাই ছেলে, একটাও মেয়ে নাই। তিনি মিমকে দত্তক নিতে চান। সে আশায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিমের দেখাশোনা করেছিলেন। এদিকে কন্যাকে দত্তক দেওয়ার বিষয়ে শুক্কুর প্রথমে রাজি না হলেও পরে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দেন।
মিমকে পেয়ে ওই নারী ও তার ছেলেরা খুবই খুশি। তারা মিমকে সাত ভাই চম্পা নামে ডাকতো। মিমের জন্য অনেক নতুন জামা উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন। এছাড়া খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করেন। কিন্তু ৫ দিন যেতে না যেতেই শুক্কুর এসে ঝামেলা শুরু করে। তার দাবি, মিমকে সে ফেরৎ নিয়ে যাবে। এমনকি দত্তক দেওয়ার সময় নেওয়া ওই পাঁচ হাজার টাকাও ফেরৎ দেবে না। সে খুব বাজেভাবে ঝামেলা সৃষ্টি করে।
জানা যায়, মূলত মাদক সেবনের টাকার জন্য শুক্কুর মিমকে দত্তক দিয়েছিল। ওই টাকা শেষ হওয়ায় সে আবার মিমকে ফেরৎ নিতে এসেছে। এদিকে মনে কষ্ট নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে মিমকে ফেরৎ দেন দত্তক নেওয়া সেই নারী। ওই নারী কান্না করতে করতে বলছিলেন, মিম তাদের সঙ্গে আপন সন্তানের মতো মিশে গিয়েছিল।
তবে এই ঘটনার প্রায় দুই মাস পর খবর পাওয়া যায় ছোট্ট মিম আর বেঁচে নেই। সে মারা গেছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক যৌনকর্মীর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, তাদের ধারণা শুক্কুর অর্থাৎ তার বাবাই মিম’কে আছড়ে মেরে ফেলেছে। বাবা কিভাবে এমন কাজ করতে পারে এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, ‘শুক্কুর খুবই খারাপ মানুষ। সে মাদকসেবন, ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের মতো ঘটনা ঘটায় প্রতিনিয়ত। শুক্কুর খুবই খারাপ এবং ভয়ংকর প্রকৃতির লোক। কথায় কথায় ছুরিকাঘাত করে। বছরের বেশিরভাগ সময় জেল হাজতে থাকেন। এখনও সে কারাগারে রয়েছে। সে ওই শিশুটির উপর অত্যাচার করেছে। এই দুধের বাচ্চাটি খাবারের অভাবের পাশাপাশি অযত্নে-অবহেলায় সবসময় অসুস্থ থাকত। তার মধ্যে শুক্কুরের মাথা গরম হলেই বাচ্চাটিকে আছাড় মারত।
এসব ঘটনা ঘটেছিল ২০১৮ সালের অক্টোবরের দিকে।
শুধু মিম নয়, শহরের যৌন কর্মীদের সন্তানেরা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শহরের লালদিঘীর পাড়ের যৌনকর্মীদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, লালদিঘীর পাড়কেন্দ্রিক অন্তত অর্ধশত যৌনকর্মীর বেশিরভাগেরই সন্তান রয়েছে। তারা শহরের সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, পাহাড়তলী, লাইটহাউস ও বৈদ্যঘোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে। তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা তো দূরের কথা; লোকজন তাদের বাসা ভাড়া পর্যন্ত দেয় না। তাদের সন্তানেরা চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান থেকে শুরু করে প্রায় সবধরণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
কান্না জড়িত কণ্ঠে পপি নামে এক যৌনকর্মী বলেন, ‘এই সমাজ আমাদের প্রয়োজন শেষে ছুড়ে মারে। ঘৃণা করে। আমরাও তো মানুষ। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এই পেশায় রয়েছি। কেউ খুশিতে এই পেশায় আসেনি। আমাদের মানুষ ঘৃণা করলে যতটুকু কষ্ট পাই, তারও বেশি কষ্ট পাই যখন আমাদের সন্তানদের ঘৃণা করে। তাদের কি অপরাধ, তাদের কেন সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে?’
আরেক যৌনকর্মী মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘আমি পুরাতন রোহিঙ্গা। আমার ৫ বছর বয়সে পরিবার মিয়ানমার থেকে চলে আসে। বাবা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরেনি। মার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। এই লাইনে আসার পিছনে অনেক কষ্টের গল্প রয়েছে। এখন আমার ২ সন্তান। মানুষের ছেলেরা স্কুলে যাচ্ছে দেখলে বুকের ভিতর কষ্ট হয়। খুব ইচ্ছে হয় আমার সন্তানরে যদি তাদের মতো লেখাপড়া করাতে পারতাম, অন্তত আমার চেয়ে ভালো থাকত। আমরা সরকারের কাছে আবেদন করছি আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার পাশাপাশি যেন মানুষের মতো মানুষ হওয়ার সুযোগ পায়।’
রোকেয়া নামে আরেক যৌনকর্মী বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকি। অর্থের অভাবে ঠিকমত খেতে পারি না। তার মধ্যে চিকিৎসা খরচ যোগার করা কষ্টের ব্যাপার। থাকা-খাওয়া ঠিকমত না হওয়ায় আমাদের শিশুরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। কেউ দেখার নেই আমাদের শিশুদের।’
যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মো. নাজমুল হক জানান, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তারা এ বিষয়ে আবগত, তারাও চান যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের সহযোগিতায় কাজ করতে। কিন্তু তাদের কাছে কেউ সহযোগিতার জন্য আসে না। ফলে ইচ্ছে থাকার পরও অনেককিছু নিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না।
সারাবাংলা/এমও