জাল সনদে সহকারী শিক্ষক— ৭ বছর বন্ধ কম্পিউটার শিক্ষা
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩০
চুয়াডাঙ্গা: কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ভুয়া সনদ দেখিয়ে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। দীর্ঘ ১৫ বছর সেই জাল সনদ দিয়েই চাকরি করেন তিনি। এরপর ধরা পড়লে নিজেই চাকরি ছেড়ে দেন। তবে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ঠিকই। সেই মামলার কারণেই ওই পদে সাত বছর ধরে বন্ধ রয়েছে নিয়োগ। বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৩০২ জন শিক্ষার্থী কম্পিউটার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাল সনদ দেখিয়ে দেড় দশক ধরে চাকরি করা ওই ব্যক্তির নাম খাইরুল ইসলাম। তিনি চুয়াডাঙ্গা চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অফিস সচিব এবং দৈনিক সমকালের চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রতিনিধি। সপরিবারে তিনি দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) হিসেবে খাইরুল ইসলাম যোগ দেন ২০০২ সালের ১ আগস্ট। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়, তার দাখিল করা সনদপত্র ছিল জাল। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে জাল সনদপত্র দাখিলের তথ্য স্বীকারও করেন। এ ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশে সোপর্দ করতে পারে— এমন সংশয় থেকে তিনি বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি ও বিজিবি পরিচালক বরাবর ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল আবেদন করে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।
এ ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা না নিলেও ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহজাবিন চন্দনার বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন খাইরুল। অভিযোগে বলেন, চন্দনা চাকরি ফিরিয়ে দিতে তার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
মামলাটি তদন্ত করেন ওই সময়ের সদর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) ওহিদুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, তদন্তে অভিযোগের কোনো ধরনের সত্যতা না পাওয়ায় তিনি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এটি সাজানো ও মিথ্যা মামলা উল্লেখ করে বাদী খাইরুলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে এ মামলায় প্রধান শিক্ষক মেহজাবিনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। পরে প্রধান শিক্ষক মেহজাবিন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সভাপতির পক্ষে চুয়াডাঙ্গা চিফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলা করেন খাইরুল ইসলামকে আসামি করে।
ওই মামলার পক্ষে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে বিদ্যালয়ে চাকরি নেওয়ার সময় খাইরুলের দাখিল করা বগুড়ার ফুলতলায় অবস্থিত জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির (নট্রামস) দাখিল করা জাল সনদ দাখিল করা হয়। বলা হয়, খাইরুল ২০০২ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা ৯৯ পয়সা বেতন-ভাতা নিয়েছেন, জাল সনদে চাকরি নেওয়ার কারণে যা প্রতারণা। এ সংক্রান্ত খাইরুলকে পাঠানো আইনি নোটিশের কপিও সংযুক্ত করা হয়।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, খাইরুলের দাখিল করা সনদটি ২০১৭ সালের ৬ মার্চ বগুড়া ফুলতলার নট্রামস পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ একাডেমির পরিচালক (উপ-সচিব) এস এম ফেরদৌস আলমের সই করা এক চিঠিতে জানানো হয়, ওই সনদটি ভুয়া।
মামলাটি তদন্ত করেন তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. তরিকুল ইসলাম। তদন্তের সময় তিনি যোগাযোগ করলে খাইরুল তাকে বলেন, দাখিল করা সনদটি তার নয়। তাকে ফাঁসানোর জন্য ওই কপি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল। পরে খাইরুল আরও একটি সনদ এএসপিকে দিয়েছিলেন। এএসপি তরিকুল জানান, নতুন সনদটিও নট্রামসে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে জানানো হয়, এই সনদটিও ভুয়া।
পরে ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট মামলাটির প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন এএসপি তরিকুল। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, খাইরুল ভুয়া সনদ দিয়ে বিদ্যালয়ের চাকরি নিয়েছিলেন। তার দেওয়া জবানবন্দি মিথ্যা। অন্যদিকে বাদীয় তথা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহজাবিন চন্দনার দায়ের করা অভিযোগটির সত্যতা পাওয়া গেছে।
এদিকে মামলাটির কোয়াশমেন্ট (আদালতের ক্ষমতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো মামলায় আসামি বা বিচারপ্রার্থীর অধিকার খর্ব করা হলে মামলাটি আইনত বাতিলযোগ্য দাবি করে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়ার প্রক্রিয়া) চেয়ে খাইরুল ইসলাম উচ্চ আদালতে মামলা করেন। ২০২৩ সালের জুন ও জুলাইয়ে একাধিক উচ্চ আদালতে উপস্থাপিত হয়েছিল। পরে ১৯ জুলাই বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের আদালত কোয়াশমেন্ট আবেদনটি খারিজ করে দেন। ফলে খাইরুলের বিরুদ্ধে চলমান নিম্ন আদালতের মামলাটি চলতে বাধা থাকে না।
অভিযুক্ত খাইরুল ইসলাম অবশ্য বলছেন, ‘মামলা আদালতে চলমান। আমি উচ্চ আদালতে এ মামলাটির ব্যাপারে কোয়াশমেন্ট চেয়েছি। তার একটি আদেশ এসেছে। আদেশটি কী, আপনি নিজেই জেনে নেন।’
চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক মেহজাবিন চন্দনা বলেন, খাইরুলের কোয়াশমেন্ট আবেদনটি হাইকোর্টে খারিজ হয়েছে। আর মামলায় ৩ এপ্রিল তার হাজিরার দিন নির্ধারণ করা রয়েছে। তিনি বিদ্যালয় ও পরে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে দুটি সনদ দিয়েছিলেন, দুটিই জাল প্রমাণিত হয়েছে। জাল সনদে চাকরি নেওয়ার পর বেতন-ভাতার টাকাও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফেরত দেননি। বরং মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছেন।
প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, খাইরুল তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছেন বলে জানতে পেরেছি। তিনি দেশ ছাড়লে এই মামলাটির আর বিচারেরর সম্ভাবনা থাকবে না। তার জালিয়াতির কোনো সাজা হবে না। ভুয়া সনদ দিয়ে যে লাখ লাখ টাকা বেতন-ভাতা তুলেছেন, তাও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফেরত পাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাইরুল বলেন, আমি সবসময় বিদেশে যাওয়া-আসা করে থাকি। প্রয়োজন হলে আবার যাব। তাতে কোনো সমস্যা নেই।
সারাবাংলা/টিআর
কম্পিউটার শিক্ষক কম্পিউটার সনদ চুয়াডাঙ্গা জাল সনদ নট্রামস বিজিবি স্কুল সহকারী শিক্ষক সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়