শুধু নামেই আন্তর্জাতিক, গবেষণাতেও পিছিয়ে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:০০
ঢাকা: বাংলা ভাষার প্রচার-প্রকাশ-প্রসারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই)’। কিন্তু অন্য দেশের ভাষা তো দূরের কথা, বাংলাদেশেরই বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত সেমিনার, নিউজ লেটার, স্মরণিকা আর কয়েকটি প্রকাশনা প্রকাশেই সীমাবদ্ধ এই ইনস্টিটিউটের কাজ।
এদিকে নামের সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক’ থাকলেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত যেসব কাজ করেছে, সেগুলো একদিকে যেমন এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের তুলনায় অপ্রতুল, অন্যদিকে মানের দিক থেকেও আন্তর্জাতিক মানের নয়। লক্ষ্য অনুযায়ী এবং মান ধরে রেখে কাজ না করতে পারার পেছনে জনবল, গবেষক ও অর্থ সংকটকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ আর জনবল বরাদ্দ পেলে তবেই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।
যেভাবে শুরু
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। ওই বছরের ডিসেম্বরে দেশে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের ঘোষণা দেন তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ২০০১ সালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। সরকার পরিবর্তন হলে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে সেই কাজ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কাজ শুরু করতে পারে।
ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বাংলা ভাষার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা সংগ্রহ ও সংরক্ষণসহ প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পাশাপাশি বাংলা ভাষাসহ অন্যান্য ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা এবং ইউনেসকোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এ সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হিসেবে। তবে প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজ গবেষণা। একইসঙ্গে ভাষা প্রমিতকরণ, বিলুপ্ত ভাষার গবেষণা ও সংরক্ষণ করাও এর অন্যতম কাজ।
১৪ বছরে যা করেছে ইনস্টিটিউট
১৯৯৯ সালে উদ্যোগ নেওয়া হলেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কাজ শুরু করে ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে আজ প্রতিষ্ঠানটির চতুর্দশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অর্থাৎ ১৪ বছর পেরিয়ে ১৫ বছরে পা রাখছে এই ইনস্টিটিউট। তবে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে মান অর্জন ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা ছিল, সে লক্ষ্যে এখনো পৌঁছাতে পারেনি ‘আমাই’।
গত দুই বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক হাকিম আরিফ। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রতিষ্ঠানের অর্জন আর সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘গবেষণা রাতারাতি করার বিষয় নয়। তার ওপর সীমাবদ্ধতাও থাকে। গবেষণা প্রকল্পের কাজ চলছে। আমি আসার পর প্রথম বছর পাঁচজন গবেষক নেওয়া হয়েছে, দ্বিতীয় বছর আটজনকে নেওয়া হয়েছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল, পিএইচডি ও পোস্ট-জবে আছেন, তাদের আমরা বৃত্তি দিচ্ছি। ফেলোশিপ ও প্রফেশনাল পর্যায়ে গবেষকরা কাজ করছেন। বর্তমানে মোট ১৩ জন গবেষক কাজ করছেন।’
অধ্যাপক হাকিম আরিফ জানান, হারিয়ে যাওয়া ভাষা নিয়ে ২০১৪ সালে একটি জরিপ করে এই ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশের ‘নৃভাষা বিজ্ঞানী সমীক্ষা’ শিরোনামের ওই জরিপ আমাইয়ের সবচেয়ে বড় কাজ। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত দুই বছরের সমীক্ষায় ৪১টি ভাষা শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র আটটির নিজস্ব লিপি আছে। বাকিগুলোর লিপি তৈরি ও প্রবর্তন করা, বিপন্ন ভাষাগুলোর শব্দ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পরিভাষা তৈরি করা— এগুলো নিয়ে ইনস্টিটিউট কাজ করছে।
অধ্যাপক হাকিম বলেন, ঠার, কোচ, র্যাংমিৎচা, ঢাকাইয়া উর্দুর মতো ভাষা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। ঠার বেদেদের ভাষা, সেটার বাংলা অভিধান করেছি। কোচ গোত্রের ভাষা কোচের বাংলা অভিধান করেছি। ঢাকাইয়া উর্দুকে বাংলা করেছি। চা বাগানে কর্মরতদের ভাষা ভোজপুরী। তাদের ভাষা নিয়ে ব্যকরণ করা হয়েছে। কিছু অভিধান করা হয়েছে। একটি অনুবাদকেন্দ্র খোলা হয়েছে। হুমায়ুন আহমদের কিছু কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় যেটি হয়েছে সেটি হলো— ওই ভাষাগুলোর উন্নয়ন হয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গাড়ো, কুরমালি ভাষাগুলোর শব্দ সংখ্যা বেড়ে গেছে।
ভাষা জাদুঘর
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নিচ তলায় বড় পরিসরে তৈরি করা হয়েছে ‘ভাষা জাদুঘর’। ২০২৩ সালে এটি উদ্বোধন করা হলেও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে এখনো কাজ চলছে। জাদুঘরটি ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষার নমুনা, জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিস্তারিত তথ্যউপাত্ত ও ছবি রয়েছে। আর সাত তলায় করা হয়েছে ভাষার লিখন রীতির আর্কাইভ।
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক হাকিম আরিফ বলেন, ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন ভাষার লিখনরীতি। আমাদের আর্কাইভে বিশ্বের ১৫২ দেশের ভাষার লিখনরীতির বিস্তারিত বর্নণা ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সেমিনার করেছি। সেখানে বাইরে থেকে বক্তরা আসেন।
আরও উদ্যোগ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি বহুভাষী পকেট অভিধান তৈরি করেছে। সেখানে বিশ্বের প্রধান ১৫টি ভাষা নিয়ে আলাদা কয়েকটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। বইগুলো সহজেই বহনযোগ্য। দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষক বা শিক্ষার্থী যে কেউ চাইলেই এটি বহন করতে পারবেন।
মহাপরিচালক বলেন, আমরা পকেট ডিকশনারি করেছি। সেখানে আমরা ১৫টি ভাষাকে নির্বাচন করেছি। বাংলা-ইংরেজি আছে। আরও আছে আরবি, ফারসি, তুর্কি, চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, জার্মান, রুশ, স্প্যানিশ ভাষা। এর সুবিধা হলো— যারা বিদেশে যাবেন, পকেটে করে নিয়ে যেতে পারবেন। ভাষা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
সিলেট অঞ্চলের ভাষা সিলোটির লিপি নাগরি লিপি। সেটি নিয়েও কাজ চলছে বলে জানান অধ্যাপক হাকিম। বলেন, নাগরি লিপি হারাতে বসেছিল। সেটাকে পুনরুদ্ধার করেছি। মানুষ যেন জানতে পারে, সেজন্য একটি বই করেছি। আরও বের করেছি মাতৃভাষাপিডিয়া। এর পাঁচটি ভলিউম রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন মাতৃভাষা নিয়ে লেখা হয়েছে। বাংলায় পাঁচটি, ইংরেজিতে পাঁচটি খণ্ড করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন।
অনেক কাজের কথা উঠে এলেও এগুলোতে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হয়নি, সেটিও প্রতিষ্ঠাটির মহাপরিচালকের বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান কখনো বজায় থেকেছে, কখনো থাকেনি। আমরা চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিদেশি বক্তরা আসছেন। তবে বাইরের লেখকরা এখানে বই লিখতে শুরু করেননি। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমাদের দেশ তো ওই অর্থে কোনো দিক থেকেই আন্তর্জাতিক হয়নি। আমাদের দেশের ভাবমূর্তি আস্তে আস্তে উন্নত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও তাই হবে দেখবেন। তবে মাতৃভাষাপিডিয়াতে আমাদের সঙ্গে বাইরের লেখকরাও এসেছেন।’
সীমাবদ্ধতার কেন্দ্রে জনবল-অর্থ
কাগজে-কলমে আমাই ১৪ বছর পার করলেও এখনো এর জন্য অনুমোদিত পদের সিংহ ভাগই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। প্রায় ১০০ জনবল থাকার কথা এই ইনস্টিটিউটে, আছে ৩৮ জন।
মহাপরিচালক অধ্যাপক হাকিম আরিফ বলেন, ইনস্টিউটের কাঠামো অনুযায়ী একজন মহাপরিচালকের অধীনে দুজন পরিচালক থাকবেন। তাদের অধীনে কয়েকটি বিধান থাকবে। তারা কাজ করবেন। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। আমাদের কর্মচারী আছে, কর্মকর্তা নেই। সহকারী পরিচালক নিজস্ব হলে এই প্রতিষ্ঠানেই তাদের প্রমোশন হবে, তারা এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, যেভাবে বাংলা একাডেমি চলে বা শিল্পকলা একাডেমি চলে। কিন্তু আমাদের এখানে এটি নেই। তবে আমরা এ প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমাদের শূন্য পদে জনবল নিয়োগ দিতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।
মহাপরিচালক আরও বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা আসেন তিন বছরের জন্য। এই সময় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে জানতেই চলে যায়। এটি বড় সমস্যা। আবার যারা বাইরে থেকে কাজ করতে আসেন, তাদের দায়বদ্ধতাও কম থাকে প্রতিষ্ঠানের প্রতি। এসব কারণে ঠিকমতো কাজ হয় না।
গবেষক আর অর্থ সংকটকেও কাজ করতে না পারার বড় সীমাবদ্ধতা মনে করছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, আগে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও এখন কিছু পাওয়া যাচ্ছে। সমস্যা হলো গবেষক না পাওয়া। আমরা সার্কুলার দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী গবেষক কম পাচ্ছি। পর্যাপ্ত বাজেটও নেই। এখন প্রতিষ্ঠানকে উন্নত করতে প্রশিক্ষিত স্থায়ী জনবল দরকার, কর্মকর্তা দরকার, প্রচুর অর্থ দরকার। এর কোনো বিকল্প নেই।
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আমাই ভাষা গবেষক ভাষা গবেষণা ভাষা নিয়ে গবেষণা