Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে আর্থিক শিল্পে অবদান রাখছে

মো. সাইফুল আলম তালুকদার
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৩৫

বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বাজারের আকার ২০২২ সালে ছিল ৫৪৫.১২ বিলিয়ন ডলার। ২০৩২ সালে ২.৫৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রিসিডেন্স রিসার্চ অনুসারে এই শিল্প ২০২৩ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে।

ব্যাংক এবং বিমা কোম্পানিগুলো বেশ কয়েক বছর ধরে এআই নিয়ে কাজ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থিক শিল্পে এআই প্রয়োগের ধারা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং এআইয়ের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার সারা বিশ্বে আর্থিক পরিষেবা খাতে নতুন পথ উন্মোচন করছে। কেওয়াইসি মূল্যায়ন, জালিয়াতি প্রতিরোধ, চ্যাটবট সহায়তা, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ পরামর্শ প্রদান থেকে শুরু করে ট্রেডিং— সবক্ষেত্রেই এআই দ্রুত আর্থিক পরিষেবা খাতের একটি মূল অংশ হয়ে উঠছে। তাই সবাই এআইকে তাদের ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং ভবিষ্যতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য অগ্রাধিকার তালিকায় রাখছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি বিবিসিকে জানিয়েছেন, এআই ব্যবহারে কিছু ঝুঁকি রয়েছে, তবে এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত।

বিজ্ঞাপন

কীভাবে এআই আর্থিক শিল্পে অবদান রাখছে এবং ভবিষ্যতে কী অবদান রাখতে পারে, তা সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক

প্রথমত: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদমগুলো অতুলনীয় গতি এবং নির্ভুলতার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেটা-চালিত সিদ্ধান্ত দক্ষতার সঙ্গে নিতে সক্ষম করে তুলছে। যেমন: এটি বিমাকারীকে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধা দেয় বা ব্যাংককে ঋণ খেলাপি অনুমান করতে সাহায্য করে।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয়ত: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত চ্যাটবট এবং ভার্চুয়াল সহকারীরা একটি বোতামের মাত্র কয়েকটি ক্লিকে ব্যক্তিগত সেবা এবং রিয়েল-টাইম সহায়তা প্রদান করে গ্রাহকদের অসাধারণ অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে। মাস্টারকার্ড সম্প্রতি খুচরা অ্যাসিস্ট্যান্ট টুল উন্মোচিত করেছে যা ক্রেতাদের উপযোগী পণ্যের সুপারিশ প্রদান করে।

তৃতীয়ত: এটি পরিচালন খরচও কমিয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। কারণ যে কাজগুলো আগে হাতে হাতে করা হতো, সেগুলো এখন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় সম্পাদিত হচ্ছে, যা কর্মীদের বিপুল সময় ও সম্পদ বাঁচিয়ে দিচ্ছে।

চতুর্থত: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর্থিক ব্যবস্থাগুলোকে আরও কার্যকরভাবে জালিয়াতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং গ্রাহকদের পছন্দকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করতে পারে। ব্যাংকগুলো খুব কঠোর নিয়ন্ত্রক কাঠামোর মধ্যে কাজ করে। কিন্তু প্রতারকদের সৃজনশীলতা এবং অসৎ কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এআই মডেলগুলোকে ধন্যবাদ, যেটি অস্বাভাবিক আচরণ সনাক্ত করতে পারে এবং জালিয়াতি ও আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি মাস্টারকার্ড তার জালিয়াতি সনাক্তকরণ প্রযুক্তিকে জেনারেটিভ এআই দিয়ে টার্বোচার্জ করছে, যা একটি লেনদেন সত্যি কিনা তা অনুমান করতে ট্রিলিয়ন ডেটা পয়েন্ট স্ক্যান করতে পারে ৫০ মিলিসেকেন্ডের কম সময়ে।

পঞ্চমত: জেনারেটিভ এআই (GenAI) স্বাধীনভাবে শেখে এবং বিকশিত হয়, যা ভবিষ্যতের জন্য দুর্দান্ত সেবা প্রদানে প্রতিশ্রুতি রাখে। আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জেনারেটিভ এআই হাইপার পার্সোনালাইজড সার্ভিস, ঝুঁকি বিশ্লেষণে পূর্বাভাস দেয়া এবং আরও উন্নত জালিয়াতি প্রতিরোধে একচ্ছত্র সুবিধা প্রদানে সক্ষম হবে। এসব ক্ষেত্রে মানব প্রজন্ম কোনোভাবেই এর সাথে পেরে উঠবে না, ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য বা কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জনে পুরনো ধ্যানধারণা ঝেড়ে ফেলে জেনারেটিভ এআইর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। হাইপার পার্সোনালাইজড সার্ভিসের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে কোনো গ্রাহক যদি ওভারড্রাফট ঘনঘন ব্যবহার করেন এবং তার সীমা অতিক্রম পর্যায়ে চলে যান, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার কাছে স্বয়ংক্রিয় বার্তা পাঠাবে যে তিনি ওভারড্রাফট সীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছেন। ম্যাককিন্সির মতে, ৭১% গ্রাহক কোম্পানির কাছ থেকে এইরকম ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়া আশা করে এবং এটা না ঘটলে ৭৬% গ্রাহক হতাশ হন। এই কারণেই ২০২৪ সালকে ক্রমবর্ধমান জেনারেটিভ এআই কৌশল বাস্তবায়ন এবং তাদের সুবিধা আরও বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা মোকাবেলা করা জরুরি হয়ে পড়েছে

• বিদ্যমান আর্থিক অবকাঠামোতে এআই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত জটিলতা একটি মূল সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

• ডেটা সুরক্ষা প্রদানে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা।

• গ্রাহক সম্মতি গ্রহণ করার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো থেকে প্রয়োজনীয় আইন পাস করা, যাতে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার রোষানলে পড়তে না হয়।

• এআই অটোমেশনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং মানুষের স্পর্শ বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা গৃহঋণের মতো জটিল সেবাতে মানুষজন এখনো আগের মতো সেবা চালু রাখার পক্ষে।‌

• অতিমাত্রায় সহানুভূতিশীল গ্রাহকদের সঠিক মিথস্ক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য স্বয়ংক্রিয় চ্যাটবটগুলোকে মানব তত্ত্বাবধানে আরও উন্নত করতে হবে।‌

• এআই গ্রহণের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্বাস অর্জন করা। কারণ, গ্রাহকদের আস্থা ও সন্তুষ্টি ব্যতীত কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান পথ চলতে পারে না। আমেরিকানরা ২০২৩ সালে জালিয়াতির জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হারিয়েছে এবং সামগ্রিক ক্ষতি আগের বছরের তুলনায় ১৪% বেশি ছিল। ইউকে ফাইন্যান্স অনুসারে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এপিপি (অথরাইজড পুশ পেমেন্ট) স্ক্যামের কারণে যুক্তরাজ্যে মোট ক্ষতি ২৩৯ মিলিয়ন পাউন্ড ছাড়িয়ে গেছে। এপিপি স্ক্যামগুলো যখন ঘটে তখন প্রতারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মিথ্যা অজুহাতে অর্থ পাঠানোর জন্য গ্ৰাহকদের প্রতারিত করে। যেহেতু রিয়েল-টাইম পেমেন্ট ব্যবস্থায় একবার অর্থ প্রদান হয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা যখন বুঝতে পারে যে তাদের ক্ষতি হয়ে গেছে তখন আর কিছু করার থাকে না। সম্প্রতি ভিসা কর্তৃক এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে প্রতি তিনজনের একজন এই স্ক্যামের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ১৯% জানিয়েছেন এই কারণে তারা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে, বর্তমানে ৩৬% ব্রিটিশ নাগরিকের ডিজিটাল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।

• অথরাইজড পুশ পেমেন্ট এআইকে আর্থিক পরিষেবা খাতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি শেষ পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বিশ্বাস গড়ে তুলতেই শুধু সাহায্য করবে না বরং তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং এআই ব্যবহার নিশ্চিত করবে।

জেনারেটিভ এআই/ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর্থিক শিল্পে আরও কী ধরনের চাহিদা তৈরি করবে

ঋণের উৎপত্তি প্রবাহ থেকে শুরু করে আন্ডাররাইটিং সব প্রক্রিয়াকে সহজতর করতে এআই ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, আইন-কানুন, প্রবিধান ও অবশ্যই করণীয় নিয়মাবলী সমূহকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। এআই আপনাকে নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য বিশ্লেষণে সহায়তা করবে তবে তা প্রয়োগের ব্যাপারে আপনাকেও সৎ থাকতে হবে।

অর্থপ্রদান এবং আর্থিক পরিষেবাগুলোতে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করতে গেলে প্রথমদিকে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীনের পাশাপাশি অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ হয়। যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুর দিকে প্রায়ই সতর্কতার সঙ্গে সম্ভাব্য সব ধরনের ঝুঁকি বিবেচনা করে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তবে এই ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চ্যাটবট ব্যবহারে এগিয়ে আসার কারণে ইন্টারেক্টিভ এআই ব্যবস্থাপনা গ্রহণের পথ প্রশস্ত হয়েছে।

যদিও এখনো অর্থপ্রদান এবং আর্থিক পরিষেবা খাতের কিছু কাজে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে, তবে বিশেষ করে উচ্চমূল্যের লেনদেন, বড় অ্যাকাউন্ট অনবোর্ডিং ও এই সম্পর্কিত বিষয়াদি দেখভালের জন্য রিলেশনশিপ ম্যানেজারের মতো মানবকর্মীর প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ, স্বয়ংক্রিয় মিথস্ক্রিয়াটি যেখানে শেষ হবে সেখান থেকে মানবকর্মীর কাজ শুরু হবে।

তবে এ কথা বলা অনস্বীকার্য যে জেনারেটিভ এআই ২০২৪ সালে ব্যাংকিং খাতে দারুণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। কারণ ২০২৩ সাল জুড়ে সবাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি ভেন্ডর বিশ্লেষণ, যাচাই-বাছাই এবং ভবিষ্যতে তারা নিজেরা কি বাস্তবায়ন করবে এই নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত ছিল। এই ধরনের উচ্চ ও সংবেদনশীল প্রযুক্তি ব্যবহার এবং পরিচালনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি নিজস্ব অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন মডেল অনুসরণে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।‌

আসন্ন বিভিন্ন আইন কানুন যেমন ডেটা সুরক্ষা এবং ডিজিটাল তথ্য বিল এআই, অ্যালগরিদম ও বড় বড় ডাটার আধার ব্যবহার করে কিভাবে মানুষের উপকারে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।‌ এই সংক্রান্ত প্রবিধান তৈরি করতে বিশ্বাস, স্বচ্ছতা, অন্তর্ভুক্তি, উদ্ভাবন, আন্তঃঅপারেবিলিটি, পাবলিক ব্যবস্থাপনা, দায়বদ্ধতা প্রভৃতি সন্নিবেশ করা প্রয়োজন। এই বছর ডাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে ১০টি এজেন্ডার মধ্যে চতুর্থ এজেন্ডা হিসেবে এআই নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যেখানে প্রধান অগ্রাধিকার ছিল কীভাবে এআইকে নগদীকরণ করা যায়, অর্থাৎ অর্থোপার্জনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০২৪ এমন একটি বছর হবে যখন আইনপ্রণেতা এবং নিয়ন্ত্রকরা উপরে বর্ণিত সমস্ত নীতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার অঙ্গীকার, কপিরাইট এবং আইপি অধিকারগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করবেন এবং শেষ পর্যন্ত এআই সম্পর্কে আরও স্পষ্টতা অর্জন করবেন। এআই যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা আনতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।‌

ভবিষ্যতে চাকরির বাজারে এআই একটি ঝুঁকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষজন আস্তে আস্তে এই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেবে, কেননা এর সম্ভাবনা বিশাল আর প্রযুক্তি বা যন্ত্র পরিশেষে আপনার জীবন মানোন্নয়নে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে। এক কথায় বলা যায়, এআইর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং নিরাপদ। আজ এবং আগামীকালের ঝুঁকি মোকাবেলা করার মাধ্যমেই আমরা এর অবিশ্বাস্য সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে পারব। নতুন প্রযুক্তি অবশ্যই নতুন বিনিয়োগ এবং চাকরির সুবিধা সৃষ্টি করবে।

ফিনটেক খাতে এআইয়ের ব্যবহার অনেক আগেই শুরু হওয়ায় আর্থিক শিল্পে তা নতুন মাত্রা ও আকার দিতে শুরু করেছে। যেহেতু আমরা ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করতে পারব না, তাই প্রযুক্তির উন্নয়নকে সঙ্গী করে নৈতিক শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীল ব্যাংকিং পরিপালনে এআই গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিদ্যমান পরিবেশে কিভাবে জেনারেটিভ এআই একীভূত করা যাবে এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ইনপুট ডেটার গুণমান নিশ্চিত করা যায় তা সাবধানে বিবেচনা করতে হবে।

উদ্ভাবন হচ্ছে একটি চলমান ট্রেনের মতো যা কখনো থেমে থাকে না, তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুর দিকে কিছুটা থেমে থেকে চিন্তা করে এবং পরবর্তীতে বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়। আর এসব কিছুর জন্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনুসারে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৭ সালের মধ্যে এআইতে তাদের ব্যয় দ্বিগুণ করার পূর্বাভাস দিয়েছে।

কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর্থিক পরিষেবা শিল্পকে রূপান্তরিত করছে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ ও বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলছে

ইন্টারনেট যাত্রার শুরু পর থেকে ডিজিটাল ব্যাংকিং মহাযাত্রায় যে নতুন পথ চলা শুরু হচ্ছে সে যাত্রায় এআই একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। দিনে দিনে ব্যাংকিং শিল্পে অফার করে এমন পণ্য ও পরিষেবার মান উন্নত করে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। এটি কেবল ডেটা পরিচালনা এবং গ্রাহকের অভিজ্ঞতা উন্নত করার জন্য কাজ করছে না, বরং প্রথাগত প্রক্রিয়াগুলোকে সরলীকৃত করে এর গতি বাড়িয়ে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করেছে এবং আরও দক্ষ করে তুলছে।

এআইর মতো প্রযুক্তির কল্যাণে ডেটা একটি আর্থিক পরিষেবা সংস্থার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছে। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উদ্ভাবনী এবং সাশ্রয়ী সমাধান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে, কারণ তারা বুঝতে পেরেছে শুধু সম্পদ থাকলেই একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সফল ব্যবসা গড়ে তোলা বা মুনাফা অর্জনের জন্য আর যথেষ্ট হবে না।

যেহেতু আমরা ডিজিটাল ক্রিয়াকলাপের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীল হয়ে উঠছি এবং পরিবর্তনশীল ল্যান্ডস্কেপের প্রেক্ষিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি, এআই ব্যবসা পরিচালনা এবং বিনিয়োগের পদ্ধতি পরিবর্তন করছে। উদ্ভাবনী শক্তি ক্রমাগতভাবে উদ্ভাবন করার অব্যাহত চাপ এবং গ্রাহকদের জন্য সর্বোত্তম সমাধান প্রদানের জন্য আর্থিক পরিষেবা খাত ক্লাউড-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ও এআই-সক্রিয় সমাধানগুলিতে চলে যাচ্ছে।

প্রতিদিনের ব্যবসায়িক কার্যকলাপে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করার ক্ষমতা বাড়ায় এআই। এটি আমাদের নিদর্শন সনাক্ত, ভবিষ্যদ্বাণী, নিয়ম তৈরি, প্রক্রিয়াগুলো স্বয়ংক্রিয় করতে এবং দক্ষতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম করে। আমরা দেখব এটা কিভাবে বিভিন্ন পক্ষ ও বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলছে।

১) ক্রেতা

গ্রাহকরা আরও সচেতন হয়ে উঠছে এবং স্বচ্ছ এবং ধারাবাহিক ও নির্ভরযোগ্য পরিষেবা আশা করছে। প্রায়ই এই পরিষেবাগুলো ২৪/৭ ভিত্তিতে অ্যাক্সেসযোগ্য। গ্রাহকের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পেতে এবং সময়মত সহায়তা প্রদানের জন্য এআই ব্যবহার করা যেতে পারে।

আর্থিক শিল্প থেকে উদাহরণ

টেক্সট-টু-স্পিচ প্রযুক্তি গ্রাহক সহায়তা চ্যানেলে প্রাকৃতিক মিথস্ক্রিয়া সমর্থনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

• গ্রাহকদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে নানান রকম সূত্র থেকে আগত তথ্যগুলো অফিশিয়াল ইমার্জেন্সি সোর্স এবং অ্যালার্ট সিস্টেম থেকে তাদের উৎস অনুসন্ধান এবং কোনো বিপদ রয়েছে কিনা তা যাচাই করতে দুর্যোগ প্রতিহত মডেলতৈরি করছে।

২) ঝুঁকি হ্রাস

গ্লোবাল রেগুলেটরি আউটলুক ২০২০ এর মতে বিশ্বের প্রায় ৩৪% ব্যাংক তাদের বার্ষিক বাজেটের ৫% কমপ্লায়েন্স খাতে ব্যয় করে আসছে, যেটি ২০১৯ সালে ছিল ২৮%। তাই ঝুঁকি কমাতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করার একটি বড় সুযোগ রয়েছে।

আর্থিক শিল্প থেকে উদাহরণ

• বিভিন্ন বিনিয়োগ ব্যাংক আউটলায়ার (একক ডেটা পয়েন্ট যা একটি গ্রুপের গড় মানের বাইরে চলে যায়) বাদ দিয়ে একটি কার্যকরী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এআই ব্যবহার করছে।

৩) কার্য প্রক্রিয়া সহজতর

এআই কার্য প্রক্রিয়া প্রবাহকে স্বয়ংক্রিয় ও মানসম্মত করতে সাহায্য করে এবং অপারেটিং খরচ কমিয়ে আর্থিক স্থায়িত্ব তৈরি করতে পারে। তাছাড়া, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়করণ কর্মীদের উচ্চ-মূল্যের ক্রিয়াকলাপগুলোতে দৃষ্টিনিবন্ধ করতে সহায়তা করে।

আর্থিক শিল্প থেকে উদাহরণ

• অনেক ব্যাংক যে সমস্ত গ্রাহক কিস্তি প্রদান করতে দেরি করে তাদের কণ্ঠ রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে তাদের ইনক্লাইনেশন অর্থাৎ কিস্তি প্রদান করার সদিচ্ছা এআইয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে থাকে। গ্রাহক সঠিক সময়ে সঠিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে কিনা কিংবা কখনো খারাপ ব্যবহার করছে কিনা তা নিরীক্ষা করা যায়।

৪) এআই চালিত স্বয়ংক্রিয় কল সেন্টারের বিধি-বিধানপরিপালন

গ্রাহক অন-বোর্ড হওয়া বা বিভিন্ন ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনে ব্যাংকের সঙ্গে তাদের হাজার হাজার কল ও কথোপকথনের সময় নানা রকম বিধি-বিধান প্রতিপালন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা সামঞ্জস্যপূর্ণ, উপযুক্ত এবং সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং কিন্তু এটা করতে হবে। যেমন: গ্রাহকে প্রমাণীকরণ, প্রয়োজনীয় ডিসক্লোজার প্রদান করা এবং সেইসঙ্গে তাদের আয়-ব্যয় সম্পর্কিত প্রশ্ন করা।

কোনো গ্রাহক যদি তাদের পণ্য ও সেবা সংক্রান্ত বিষয় বুঝতে অসুবিধার সম্মুখীন হন বা বিভ্রান্তিতে থাকেন তবে তা দূর করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের।

গৃহঋণের মতো জটিল সেবাতে অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগত পদ্ধতিতে গ্রাহকদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন বা মিথস্ক্রিয়া শতভাগ জবাব বা পূর্ণ করা সম্ভব হয় না, যেটা এআইর মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। কিছু ক্ষেত্রে জটিল গ্রাহকদের জটিল সেবা পূরণে মানবসম্পদ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সব মিলিয়ে এআই ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মানব স্পর্শ পরিহার করে চলতে পারে।

প্রযুক্তি আপনাকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। অর্থাৎ, আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে, নৈতিকতা প্রয়োগ এবং অন্যায্য পক্ষপাতিত্ব থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দূরে রাখে।

৫) গ্রাহকদের ডিজিটাল পরিচয় পরিচালনা

গ্রাহকদের ডিজিটাল পরিচয় সঠিকভাবে পরিচালনা গ্রাহক আনুগত্য এবং প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে। কারণ গ্রাহকরা ডেটা-চালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকতে পছন্দ করেন। অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে, বর্ধিত ডেটাতে আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত অ্যাক্সেস অধিকার অর্জন, মানবিক ত্রুটি হ্রাস এবং গোপনীয়তা সুরক্ষা বজায় রাখা। ডিজিটাল পরিচয়ভিত্তিক ডাটাবেস তৈরি হয়ে গেলে, ব্যবসায়িক প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতার স্তরের উপর ভিত্তি করে তাদের মূল্যায়ন এবং অগ্রাধিকার নিম্নলিখিতভাবে দিতে হবে।

• প্রথমে উচ্চ সম্ভাব্যতা, ব্যবসায়িক প্রভাব এবং সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক মূল্য বিবেচনা করতে হবে।

• দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়িক প্রভাব কম কিন্তু উচ্চ সম্ভাব্যতা রয়েছে, সেইক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি ও খরচ-হ্রাস করে ন্যূনতম প্রচেষ্টায় ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

• তৃতীয় ক্ষেত্রে যা হতে পারে, তা যুগান্তকারী প্রচেষ্টা বলে ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে সকল প্রতিরোধ জয় করে প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যা পরিশেষে ভাল মূল্য যোগ করবে।

• শেষ পর্যায়ে থাকবে যার ব্যবসায়িক প্রভাব এবং সম্ভাব্যতা উভয়ই কম আছে।

ব্যাংকিং সেক্টরে এআই প্রয়োগ করার অনেক সুযোগ থাকলেও আপনাকে প্রথমে যে বিষয়ে নজর দিতে হবে সেটি হলো এটি কী পরিমাণে আপনার ব্যবসায়িক পরিধি ও মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে তা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা যাতে অপ্রত্যাশিত ঘটনা দ্বারা ব্যাহত না হয় তার জন্য ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ।

এআই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন একটি রোল-আউট চক্রের মতো এবং প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন, যারা জানবেন কোন কোন পর্যায়ে নতুন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করা হবে এবং কেন হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। পরিশেষে, নতুন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করা হবে এবং কেন আপনি এটি ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা প্রয়োজন কারণ গ্রাহক ও পরিষেবা সরবরাহের মূলে থাকার মাধ্যমে এআই প্রযুক্তি একটি দুর্দান্ত ভিত্তি তৈরি করে।

শুরুর মতো শেষ করব আরেকটি তথ্য দিয়ে। মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভারত সফরে মুম্বাইতে জানিয়েছেন, তারা ভারতের প্রায় ২০ লাখ লোককে এআই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন খুব দ্রুত, কেননা এআই ভারতের জিডিপিতে ২০২৫ সালের ভেতরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার যোগ করতে সাহায্য করবে। তিনি আরেকটি উদাহরণ দিয়েছেন, শিল্প বিপ্লবের সময় যুক্তরাজ্য তার জিডিপির ১০% ব্যয় করেছিল রেলপথ নির্মাণে। অর্থাৎ, এখন আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি নতুন প্রযুক্তিতে নিবিড়ভাবে বিনিয়োগ করবেন।

লেখক: ব্যাংকার, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি

সারাবাংলা/আইই

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর