শেষ মুহূর্তে জমজমাট বইমেলা, মননশীল বইয়ে ঝুঁকছে পাঠক
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:৫৭
ঢাকা: প্রতি চার বছর পর পর আসে লিপইয়ার বা অধিবর্ষ। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসটি ২৯ দিনে শেষ হবে। যদিও অন্যবছরগুলোতে ২৮দিনেই মেলার সমাপ্তি টানে। কিন্তু লিপইয়ারে একটি দিন বেশি পাওয়া যায়। এবারও মেলা একদিন বেশি পাচ্ছেন প্রকাশক ও পাঠকরা। যদিও প্রকাশকদের কাছ থেকে বইমেলা আরও দুই দিন বাড়ানোর দাবি উঠেছে। যদি বইমেলা দুই দিন বাড়ে সেক্ষেত্রে আরও একটি শুক্র ও একটি শনিবার পাবে বইমেলা।
যাই হোক অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনগুলোত মেলায় ভিড় থাকে বেশি। সেক্ষেত্রে কেনাকাটাও হয় বেশি। সেই ধারাবাহিকতায় মেলা শেষের আগে সরকারি ছুটির দিন শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ছিল মেলায় উপচে পড়া ভিড়। আর এই ভিড়ে পাঠকের সংখ্যাই ছিল বেশি। বিশেষ দিবসগুলোতে পাঠকের চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি থাকে। সেজন্য বিড়ম্বনাও থাকে বেশি। কিন্তু আজ মেলায় পাঠকের হাতে হাতে বই দেখা গেছে। আর ব্যস্ততা দেখা গেছে কেনাকাটায়।
আজ শনিবার গতকালের মতো মেলার প্রবেশপথের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পাঠকদের ঢুকতে দেখা গেছে। মেলার ভেতরও দর্শনার্থীদের পদচারণায় ছিল মুখর। এদিন শিশুপ্রহর থাকায় অনেকে এসেছেন বাচ্চাসহ পরিবারে সদস্যদের নিয়ে। বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলের সামনে ছিল সব বয়সি পাঠকদের ভিড়। কেউ বই দেখছেন, কেউ কিনছেন, আবার কেউ বই নিয়ে ছবি তুলছেন।
এদিকে, বইমেলায় মননশীল বইয়ে ঝুঁকছে পাঠক বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। গত এক দশকে দেশের পাঠক সমাজে বিরাট এক পরিবর্তন এসেছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গবেষণা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, দর্শন, সংগীত, বিজ্ঞান, ভ্রমণ ও ধর্মবিষয়ক বইয়ের পাঠকও। দেশের ছোট-বড় সবগুলো প্রকাশনা এখন মননশীল ধারার বই প্রকাশ করছে। কিছু কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তো এই ধরনের বইকেই তাদের মূলধারা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে মননশীল বইয়ের আলাদা পাঠককূলও তৈরি হয়েছে।
মিরপুর থেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন মাকসুদুর রহমান সঞ্চয়। সারাবাংলার সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেন, ‘আজ নিয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো মেলায় এলাম। এর আগে একদিন এসেছিলাম। ওইদিন কেনা বইগুলো ছেলে পড়ে শেষ করে ফেলেছে। এর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে নতুন বই কেনার জন্য এসেছে। সে প্র প্রকাশন থেকে সুমন্ত আসলামের তিনটি কিশোর উপন্যাস ও গল্পের বই কিনেছে। আমার স্ত্রীও কিছু অনুবাদ বই কিনেছেন। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় অবশ্য ভ্রমণ, গবেষণা ও দর্শনের বই বেশি।’
প্রতিটি ছুটির দিনের মতো আজও শিশুপ্রহর মাতিয়ে রেখেছিল সিসিমপুরের হালুম ইকু আর টুকটুকি। মেলার শেষের দিকের ছুটির দিন হওয়ায় এদিন ভিড়ও ছিল বেশি। হলিক্রস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাথিয়াকে নিয়ে মেলায় এসেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা আসাদুল হক। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বছরে এই মাসটির অপেক্ষায় থাকে আমার বাচ্চা। আমি প্রায় প্রতি শুক্র ও শনিবার মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসার চেষ্টা করি। অন্তত এই মাসটিতে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। মেয়েকে শিশুতোষ ক্ল্যাসিক বই কিনে দিই। এছাড়া তার পছন্দ মতো বই কেনে মাস জুড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বইয়ের প্রতি ঝোঁক থাকলে বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি কমে যায়। আর বইমেলার পরিসর বড় হওয়ায় ও শিশু প্রহর থাকায় খেলার আমেজে থাকে বাচ্চারা। যেটি এই মুহূর্তে খুব বেশি প্রয়োজন।’
প্রথমার এক বিক্রয় প্রতিনিধি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম আলোর আরেকটি নতুন প্রকাশনার নাম প্র প্রকাশন। এবার সেখান থেকে বেশ কয়েকটি বই বের হয়েছে। বেশিরভাগই শিশুতোষ ও কিশোরদের উপযোগী। আমাদের সৃজনশীল, মননশীল ও অনুবাদ গ্রন্থের পাশাপাশি শিশুতোষ বইও ভালো বিক্রি হচ্ছে।’
আগামী প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি সোলায়মান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ শিশুপ্রহরের সময় সকালে বিক্রি একটু কম ছিল। তবে দুপুরের পর থেকে ভালোই বিক্রি হচ্ছে।’ ইউপিএল’র বিক্রয় প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের গবেষণাধর্মী ও ক্ল্যাসিক বই বেশি চলে। এবারও এইসব বইয়ের দিকে পাঠকের আগ্রহ বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
অপরদিকে আজ বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, কথাপ্রকাশ এবার বাজারে এনেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাতচল্লিশের দেশভাগে গান্ধী ও জিন্নাহ’, যতীন সরকারের ‘সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা’, সনৎকুমার সাহার ‘অর্থনীতির ন্যায় অন্যায়’, জাহীদ রেজা নূরের ‘৬ দফা থেকে স্বাধিকার’সহ উল্লেখযোগ্য সব বই।
এতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মো. ইউনূস আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কথা প্রকাশকে পাঠকরা চেনেন গবেষণা, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাসবিষয়ক বইয়ের জন্য। মননশীল এই বইগুলোর আলাদা পাঠক রয়েছে। বিক্রি ভালো বলেই আমরা এখন এই ধারার নানা বিষয়কে উপজীব্য করে উপন্যাস বাজারে আনছি। ‘লেলিন’ উপন্যাসটি তেমনই।’ ছয় বছরের চেষ্টায় উপন্যাসটি লেখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এবারের বইমেলায় প্রথমার একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে প্রবন্ধ, ইতিহাস ও গবেষণা। তারা আনু মুহাম্মদের লেখা ‘অর্থশাস্ত্র ইতিহাস, দর্শন রাষ্ট্রনীতি’, মহিউদ্দিন আহমদের ‘প্লাবনভূমির মহাকাব্য’, বদিউল আলম মজুমদারের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি’, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী’সহ আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই বাজারে এনেছে। এই বইগুলোর কাটতিও বেশি ভালো বলে জানান প্রথমার ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন।
সারাবাংলার এই প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, ‘গবেষণা, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, আত্মজীবনী, অনুবাদ, ধর্মীয়, গণিত, বিজ্ঞানের বইগুলোর বড় ধরনের পাঠক শ্রেণি গড়ে উঠেছে। আর এই বইগুলো শুধু মেলায় নয়, সারা বছরই বিক্রি হয়।’
এদিকে, মননশীল অন্যান্য বইয়ের মধ্যে এবারের বইমেলায় স্বকৃত নোমানের ‘বাংলার ইসলাম সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’ এনেছে পাঠক সমাবেশ, কবীর আলমগীরের ‘ফ্যাসিবাদ: সাম্প্রতিক বিবেচনা’ প্রকাশ করেছে বাংলানামা, কাবেদুল ইসলামের ‘গণপরিষদ বিতর্কের আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান জন্মকথা’র প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স।
এ ছাড়া, ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ‘শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু বইটি মেলায় এনেছে আগামী প্রকাশনী, সময় প্রকাশন এনেছে ‘কী চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু’। আরেক নামকরা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাহিত্যের নায়িকাদের তিন অধ্যায়’।
অনুবাদের বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ফ্লাটল্যান্ড—এডুইন এ অ্যাবট, অনুবাদ: উচ্ছ্বাস তৌসিফ (আফসার ব্রাদার্স); প্রবাল দ্বীপ—রবার্ট মাইকেল ব্যালান্টাইন অনুবাদ: রকিব হাসান (প্রথমা); অ্যালিসের অগ্নিগাথা—ইয়োন ফসসে, অনুবাদ: বিনয় বর্মন (কথা প্রকাশ); শাসকবিহীন জনগোষ্ঠী নৈরাজ্যের নৃবিজ্ঞান—হ্যারল্ড বার্কলে, অনুবাদ: আনন্দ অন্তঃলীন (কথা প্রকাশ) ইত্যাদি।
অমর একুশে বইমেলার আয়োজনে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন-নতুন বই। শনিবার ২৪তম দিনে মেলায় এসেছে ১৩৮ নতুন বই। এ নিয়ে এবারের বইমেলায় প্রকাশ হওয়া নতুন বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ৭৩৯টি। এদিন বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ থেকে বিষয়টি জানানো হয়।
জানা যায়, শনিবার মেলায় যেসব বই প্রকাশ হয়েছে তার মধ্যে গল্প ২৩টি, উপন্যাস ১৬টি, প্রবন্ধ ৪টি, কবিতা ৫৩টি, গবেষণা ৩টি, ছড়া ৪টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনী ৩টি, রচনাবলি ১টি, মুক্তিযুদ্ধ ৪টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান ১টি, ভ্রমণ ১টি, ইতিহাস ২টি, রাজনীতি ১টি, স্বাস্থ্য/চিকিৎসা ২টি, বঙ্গবন্ধু ১টি, রম্য/ধাঁধা ১টি, ধর্মীয় ২টি, অনুবাদ ২টি, অভিধান ১টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য বই এসেছে ৯টি।
সারাবাংলা/পিটিএম