ভবনজুড়ে ছড়ানো-ছিটানো সিলিন্ডার, গ্রিন কোজি কটেজ যেন মৃত্যুকূপ
১ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৮
ঢাকা: সাত তলা ভবন। অধিকাংশ তলাতেই রেস্তোরাঁ। রয়েছে একটি মোবাইলের শোরুম, একটি পোশাকের শোরুমও। অবস্থান বেইলি রোডে, বলা যায় রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রেই। স্বাভাবিকভাবেই জনসমাগমে সবসময়ই জমজমাট গ্রিন কোজি কটেজ। ছুটির দিন তো বটেই, এখানকার রেস্তোরাঁগুলো সন্ধ্যার পর প্রায় সব দিনেই ভরপুর ভোজনরসিকদের উপস্থিতিতে। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনের আগে যেন মানুষের ঢ্ল নামে এই ভবনে।
অবশ্য নামবেই বা না কেন, সাত তলা ভবনটিতে যেসব রেস্তোরাঁর অবস্থান, তার সবগুলোই জনপ্রিয় ব্যান্ড। কাচ্চি ভাই, খানা’স, বার্নওয়েল, ওয়াফল অ্যান্ড জুস বার, ফুওকো হটের মতো খাবারের ডেরায় কে না ঢুঁ মারতে চায়! সঙ্গে পোশাকের অভিজাত ব্যান্ড ইল্লিয়িন আর গ্যাজেটস অ্যান্ড গিয়ারের শোরুম ভবনটিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু গন্তব্যই যে সবার অগোচরে পরিণত হয়ে আছে মৃত্যুকূপে, তা কে ভবতে পেরেছিল?
হলো ঠিক তাই। মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়া প্রিয় গন্তব্যে ঠিক ঘটল বিস্ফোরণ। উত্তাপে পুড়ল গ্রিন কোজি কটেজ। আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিল ৪৪টি প্রাণ। এখানেই শেষ নয়, সেই মৃত্যুকূপ থেকে বের হয়ে আসা আরও অনেকেই এখনো মৃত্যুর প্রহর গুনছেন হাসপাতালের শয্যায়।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে সেই আগুনের সূত্রপাত গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে। ধারণা কর হচ্ছে, কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের পাশাপাশি আনসারের তিন ব্যাটেলিয়ন, এজিবির এক ব্যাটেলিয়ন আর বিজিবি, র্যাব, পুলিশ সদস্যদের দুই ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে, ততক্ষণে ঝরে গেছে ৪৪টি তাজা প্রাণ।
এরকম একটি অভিজাত ভবনের এই হাল কেন? ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইন উদ্দিন ভবনটি নিয়ে রাতে গণমাধ্যমকে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে ফের উঠে এসেছে ঢাকা শহরের আরও শত সহস্র ভবনের পুরনো ‘রোগে’র কথা— অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে একেবারেই শূন্য প্রস্তুতি ছিল এই ভবনের।
মইন উদ্দিন বলেন, দ্বিতীয় তলা ছাড়া ভবনটির প্রতিটি তলায় সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। এটা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ এরকম একটা জায়গায় আগুন লাগলে একের পর এক সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। হয়েছেও তাই। গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে এবং দাউদাউ করে জ্বলেছে। প্রায় সব তলাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
সাত তলা এই ভবনে সিঁড়ি মাত্র একটি। তবে ভবনটিতে ওঠানামার জন্য সবাই লিফট ব্যবহার করে থাকেন। সিঁড়িটি বরং যেন সিলিন্ডারের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নেই জরুরি বহির্গমন পথও।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মইন বলেন, আমরা তদন্ত করে দেখছি,ভবনটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ ভবনে মাত্র একটি সিঁড়ি। আমাদের কাছে ভবনটিকে মনে হয়েছে অনেকটা আগুনের চুল্লির মতো।
এই ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের হারই বেশি বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক। বলেন, আগুনে দগ্ধ না হয়ে মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অর্থাৎ অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন বা অচেতন হয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়েও ফায়ার সার্ভিসের ডিজির এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। হাসপাতালটিতে গ্রিন কোজি কটেজ থেকে মরদেহ এসেছে ৩৩টি। তাদের শরীর দগ্ধ হয়েছে কমই। দগ্ধ হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে, যেই ১০ জনের মরদেহ রয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।
অর্থাৎ ভবনের নামের সঙ্গে ‘কোজি’ বা বাংলায় ‘আরামদায়ক’ থাকলেও আগুন লাগার পর যারা ভবনটিতে আটকা পড়েছিলেন, একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ তাদের জন্য ভবনটিকে উল্টো গ্যাস চেম্বারে পরিণত করে।
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রাথমিক পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে একই তথ্য। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) ড খ মহিদ উদ্দিন বলেন, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করেছি সবাইক নিরাপদে বের করে আনার জন্য। হতাহতের ঘটনা আছে। কেউ কেউ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এর বাইরে অনেকেই দম বন্ধ হয়ে বা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪৪ জন বলে জানা গেলেও এই মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কাই করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ গ্রিন কোজি কটেজ থেকে অচেতন অবস্থায় যাদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের কয়েকজনের অবস্থা সংকটাপন্ন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢামেক হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে মোট ৪৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ১ জন, ঢামেক হাসপাতালে ৩৩ জন ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জনের মরদেহ রয়েছে।
রাতে ঢামেক হাসপাতালে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা মেডিকেলে ১৪ জন ও বার্ন ইনস্টিটিউটে আটজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। এরবা বাইরেও কেউ কোথাও ভর্তি আছেন কি না, এ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
এদিকে কাচ্চি ভাইসহ ওই ভবনের কর্মীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাব-৩ বলছে, কাচ্চি ভাইয়ের নিচ তলায় আগুনের সূত্রপাত। গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজজনিত ত্রুটি থেকে আগুন লাগতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুন লাগার খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্প থেকে আনসার সদস্যরা এগিয়ে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা রক্ষা ও উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তিন প্লাটুন আনসার সেখানে মোতায়েন ছিলন। আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এজিবি সদস্যের একটি প্লাটুন মোতায়েন করা হয়। পরে বিজিবি সদস্যরাও সেখানে যুক্ত হন।
ভবনটির ছাদসহ বিভিন্ন তলায় অনেকেই আটকা পড়েছিলেন। টার্ন টেবল ল্যাডার (টিটিএল) ব্যবহার করে ছাদ ও বিভিন্ন তলা থেকে সবাইকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন ফায়ার সার্ভিস, আনসার ও বিজিবি সদস্যরা। বিভিন্ন তলার দেয়ালের কাঁচ ভেঙেও উদ্ধার করা হয় অনেককে।
সারাবাংলা/টিআর/এনএস