প্রাণহানির পর টনক নড়ল কর্তৃপক্ষের, রাজধানীজুড়ে রেস্তোরাঁয় অভিযান
৫ মার্চ ২০২৪ ১৪:০৪ | আপডেট: ৫ মার্চ ২০২৪ ১৬:২৪
ঢাকা: অপরিসর সড়ক। তার দুপাশজুড়ে প্রায় সব ভবনই আবাসিক। সেসব ভবনের প্রায় প্রতিটিতেই একাধিক রেস্তোরাঁ। বেশির ভাগ রেস্তোরাঁতেই রান্নাঘর আকারে অত্যন্ত ছোট। চার ফুট বাই ছয় ফুট আকৃতির ছোট্ট সেই রান্নাঘরেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন সাত থেকে আটজন। নিরাপত্তার বালাই নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় পর্যন্ত নেই!
এ চিত্র একসময়ের অভিজাত ওয়ারী আবাসিক এলাকার র্যানকিন স্ট্রিটের। এখন সেখানকার প্রায় প্রতিটি ভবনেই দেখা মিলবে রেস্তোরাঁর। কোনো কোনোটিতে রেস্তোরাঁ একাধিক। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের ভয়াবহ আগুনে প্রায় অর্ধশত প্রাণহানির পরও এসব রেস্তোরাঁ মালিকদের টনক নড়েনি। অগ্নিনিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না রেখেই দিব্যি চলছে এসব রেস্তোরাঁ।
এই এলাকাটিতেই সোমবার (৪ মার্চ) অভিযান চালিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এই এলাকাতেই শুধু নয়, সোমবার দিনভর রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকাতেও আলাদা আলাদা করে অভিযান চালিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। অভিযানের কারণে সোমবার দিনভর ধানমন্ডির বেশির ভাগ রেস্তোরাঁই বন্ধ দেখা গেছে।
আরও পড়ুন- ভবনে আগুন: ক্রেতাশূন্য বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ-শপিং মল
র্যানকিন স্ট্রিটের সবগুলো রেস্টুরেন্টই গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনে। এ ছাড়া রাস্তাতেও অসংখ্য স্ট্রিটফুড ভ্যান। সড়কের রোজভ্যালি শপিং মলের একটি রেস্টুরেন্টে আগুন লেগেছিল বেইলি রোডের আগুনের ঠিক পরদিন, গত শুক্রবার (১ মার্চ)। ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও রেস্টুরেন্টটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার পাশেই রয়েছে আরও কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। সেগুলোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
এখানেই রয়েছে জনপ্রিয় মেজ্জান হাইলে আইয়ুন, বার্গার এক্সপ্রেসসহ একাধিক রেস্টুরেন্ট। রোজভ্যালির শুধু একটি ফ্লোরেই রয়েছে ছয়টি রেস্টুরেন্ট। দোতলায় শিশুদের ইনডোর গেমিং জোন বাবুল্যান্ড, নিচতলায় মোবাইল ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির শো-রুম। এই রেস্তোরাঁগুলোতে কোথাও কোথাও রাখা গ্যাস সিলিন্ডার। এ ছাড়া ভবনের একটি সিঁড়ি খোলা থাকলেও ইমার্জেন্সি এক্সিট তথা জরুরি বহির্গমণের সিঁড়ি তো বটেই, ব্যালকনির দরজা পর্যন্ত তালাবদ্ধ। ফলে ভূমিকম্প বা অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে বের হওয়ার জন্য সিঁড়ি ওই একটিই। নিচের দিকে চারটি তলাজুড়ে রেস্টুরেন্ট ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির দোকান। ওপরের দিকে সব তলায় আবাসিক ফ্ল্যাট।
রাস্তার অন্যপাশে আরেকটি তিন তলা ভবনের ছাদে গড়ে তোলা হয়েছে রুফটপ রেস্তোরাঁ। তৃতীয় তলাতেও একাধিক রেস্তোরাঁ। সেগুলো খুব সংকীর্ণ পরিসরে অনেকটা ঘিঞ্জিভাবে সাজানো। ছোট ছোট সব রান্নাঘরে গাদাগাদি করে কাজ করছিলেন শেফ ও তাদের সহকারীরা।
দোতলায় পোশাকের শো-রুম। অত্যন্ত সরু একটি সিঁড়ি ছাড়া সেই ভবনে ওঠানামার কোনো পথ নেই। তার ওপর দোতলায় একটি পোশাকের শো-রুম তাদের ম্যানিকুইন দাঁড় করিয়ে চলাচলের পথ আরও সংকীর্ণ করে ফেলেছে। হঠাৎ দুর্ঘটনায় ওপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যাওয়া ছাড়া নামার সুযোগই যেন নেই।
আরও পড়ুন-
- ধানমন্ডির কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজা সিলগালা
- ওয়ারীতে রেস্টুরেন্টে পুলিশের অভিযান, আটক ১৬
- অফিসের অনুমোদনে রেস্তোরাঁ, ‘বন্ধ’ টুইন পিকে রাজউকের অভিযান
- গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো রুফটপ রেট্রো লাইভ, আরও ১২ রেস্তোরাঁ সিলগালা
ভবনটির কেয়ারটেকার মোহাম্মদ হারুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন এই ভবনে অন্তত দুই থেকে আড়াই শ মানুষ যাওয়া-আসা করেন। বাড়িওয়ালা পাশেই অন্য ভবনে থাকেন।’
এই এলাকার অন্তত ১৫টি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা গেল, নামি-দামি দুয়েকটি চেন রেস্তোরাঁ ছাড়া অধিকাংশ রেস্তোরাঁতেই নেই অগ্নিনিরাপত্তা ও নিরাপদ বহির্গমণের ব্যবস্থা।
রাস্তার দুই ধারে এভাবে নিয়মনীতি না মেনে রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠা নিয়ে সন্তুষ্ট নন স্থানীয় এলাকাবাসীও। তারা বলছেন, চোখের সামনেই ধীরে ধীরে গোটা এলাকা বাণিজ্য এলাকায় পরিণত হয়ে গেছে। এখন প্রতিটি বাড়ির নিচতলায় দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আগে এলাকার গলিগুলোতে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করা গেলেও এখন রিকশার দৌরাত্ম্যে হেঁটেও চলা দায়, রিকশাগুলোও সড়কে জট লেগে দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাড়িওয়ালারা অতি মুনাফালোভী হয়ে একসময়ের অভিজাত আবাসিক এই এলাকাটিকে বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করেছেন।
এলাকাটিতে অভিযানের খবর পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই খুশি হয়েছেন। অভিযানের ফসল হিসেবে ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, সেটি তারা চান। তবে বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান চালিয়ে আদৌ সেটি করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহও পোষণ করছেন।
পরিবার নিয়ে পাঁচ বছর ধরে ওয়ারীতে বসবাস করেন ব্যাংকার রমা রানী দত্ত। বড় দুর্ঘটনার পরই কেন অভিযান চালানো হয়— এমন প্রশ্ন রেখে রমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে অভিযান চালিয়ে লাভ নেই। যেখানে-সেখানে রেস্তোরাঁ বানিয়ে এলাকাটিকে একদম অনিরাপদ করে ফেলা হয়েছে। এর জন্য দরকার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। আবাসিক এলাকায় রেস্তোরাঁর অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’
এদিকে অভিযান শেষে ডিএমপির উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘আমরা গতকাল (রোববার) থেকে অভিধানে নেমেছি। বিশেষ করে আমাদের ওয়ারী থানার র্যানকিন স্ট্রিট অনেক ব্যস্ত একটি জায়গা। এই একটি রাস্তায় ৫০টিরও বেশি রেস্তোরাঁ আছে। আমরা রেস্তোরাঁগুলো পরিদর্শন করেছি।’
রেস্তোরাঁগুলো পরিদর্শনে নিরাপত্তার ইস্যুটিই বড় করে সামনে এসেছে। সব রেস্তোরাঁতেই নিরাপত্তা পরিস্থিতি হতাশাজনক। ডিসি ইকবাল বলেন, পরিদর্শনে আমরা যা পেয়েছি তা হলো— বেশির ভাগ রেস্তোরাঁই আবাসিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে তারা রান্নার কাজ চালাচ্ছেন। আমরা পরিদর্শন করে দেখেছি, রেস্তোরাঁগুলো কাস্টমার সেফটি কোড, কিচেন কোড কিছুই নিশ্চিত করতে পারেনি।
ডিসি বলেন, এমনকি এ-ও দেখেছি যে কিচেন চার ফুট বাই ছয় ফুট জায়গার মধ্যে করা হয়েছে। এমন জায়গার মধ্যে সাত থেকে আটজন শেফ রান্না করছেন। যে দরজা খুলে কিচেন থেকে বের হবে, সেই দরজার সামনে চালের বস্তা, আটার বস্তা রাখা। একই পাশে সিলিন্ডার, জেনারেটর একসঙ্গে। মূলত চরম অনিরাপদ অবস্থায় রেস্টুরেন্টগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে।
বেইলি রোডের বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের পর রোববার (৩ মার্চ) থেকেই রাজধানীজুড়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। এই অভিযান চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অপরাধ বিভাগের যুগ্ম কমিশনার আলমগীর হোসেন।
রোববার একদিনেই ঢাকার সবগুলো এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৮১ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ছাড়া ২১৫ জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, পাঁচজনের নামে নিয়মিত মামলা করা হয়। রেস্টুরেন্টে নিরাপত্তার কোনো শর্ত পূরণ না করায় রেস্তোরাঁর মালিক, ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজন ভবন মালিকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয় ডিএমপি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি পুলিশ আলাদা অভিযানে কী দেখছে— জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই সংস্থাগুলোকে আমরা সহযোগিতা দিচ্ছি। সেইসঙ্গে এত বড় দুর্ঘটনার পর আমরাও অভিযান চালাচ্ছি। কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে কি না, সেটিই মূলত আমরা দেখছি।
এদিকে সোমবার ধানমন্ডি এলাকায় দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশন (ডিএসসিসি)। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি যাচাই করছি। প্রয়োজনে ভবন মালিকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযানের সময় সাত মসজিদ রোডের কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার অধিকাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ পাওয়া যায়। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়ায় সেখানকার প্রতিষ্ঠানটি সেখানে থাকা ‘ভিসা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’কে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়াও সামগ্রিকভাবে কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা থাকায় পুরো ভবনটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
অভিযানে পাশের রূপায়ন জেড আর প্লাজাতেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতি পাওয়া যায়। দ্য বুফে এম্পায়ার, বাফেট লাউঞ্জ ও বাফেট প্যারাডাইজ নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিকে এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
আলাদা অভিযানে সোমবার রাজউকের একটি দল রাজধানীর ধানমন্ডিতে গাউছিয়া টুইন পিকের ছাদে গড়ে ওঠা রেট্রো লাইভ কিচেন রুফটপ রেস্তোরাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়। ভবনটির নকশায় ছাদ ছিল খোলামেলা, সেখানে অবৈধভাবে রুফটপ রেস্তোরাঁটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
এই অভিযানেও প্রায় সব রেস্তোরাঁই বন্ধ পাওয়া গেছে। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা রাজউকের পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার সেসব রেস্তোরাঁ সিলগালা করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ভবনজুড়ে প্রচুর অনিয়ম। এফ ওয়ান ক্যাটাগরি তথা অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে রেস্তোরাঁ ছাড়াও ফার্মেসি ও পোশাকের দোকান রয়েছে। এসব অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন, কলকারাখানা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে জানাব।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
অগ্নিনিরাপত্তা অবৈধ রেস্তোরাঁ অভিযান ওয়ারী ডিএসসিসি ডিএসসিসির অভিযান ধানমন্ডি পুলিশের অভিযান ভবনে আগুন রাজউক রাজউকের অভিযান রেস্তেরাঁয় আগুন রেস্তোরাঁ