বিদেশি নাগরিকের কক্ষে ৪১ ঘণ্টা কী ঘটেছিল— উত্তর খুঁজছে পুলিশ
৫ মার্চ ২০২৪ ১৯:১৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামে আবাসিক হোটেল থেকে বিদেশি নাগরিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনা তদন্তে নেমে পুলিশ মূলত একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত্যুর আগে প্রায় ৪১ ঘণ্টা হোটেলের কক্ষে থাকলেও একবারও বের হননি বিদেশি ওই নাগরিক। এ সময় ওই কক্ষে কে বা কারা এসেছিল, সেই কক্ষে কী ঘটেছিল— এর মধ্যেই মৃত্যুর রহস্য আটকে আছে।
মৃত্যুরহস্য উদঘাটনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে পুলিশ এ ঘটনায় খুনের অভিযোগে মামলা নিয়েছে। যদিও তারা এটি হত্যাকাণ্ড কি না সেটি নিশ্চিতে মেডিকেল প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছে।
সোমবার (৪ মার্চ) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর চকবাজার থানার জিইসি মোড়ে ‘দ্য পেনিনসুলা চিটাগং’ হোটেলের ৯১৫ নম্বর কক্ষে বিদেশি নাগরিকের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ ও সুরতহাল প্রতিবেদনের প্রস্তুতের পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় রাতে পোল্যান্ডের ফ্যাশন রিটেইলার প্রতিষ্ঠান বিগ স্টার লিমিটেডের কান্ট্রি ম্যানেজার পার্থ প্রতিম ঘোষ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা এক বা একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন।
মামলার এজাহারের তথ্যানুযায়ী, মৃতের নাম- ZDZISLAW MICHAL CZERYBA (জিস্ল মিকেল জেরিবা)। বয়স ৫৮ বছর। তিনি পোল্যান্ডের নাগরিক। পোল্যান্ডের ফ্যাশন রিটেইলার প্রতিষ্ঠান বিগ স্টার লিমিটেডে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
সিইপিজেডের ক্যান পার্ক বাংলাদেশ অ্যাপারেলস প্রাইভেট লিমিটেড পরিদর্শনের জন্য গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রামে আসেন। ক্যান পার্কের মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার আশরাফুল হক ডালিম ওইদিন তাকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। ক্যান পার্কের পক্ষ থেকে বুকিং দেওয়া হোটেলের ৯১৫ নম্বর কক্ষে ডালিম তাকে তুলে দেন।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার (৪ মার্চ) সকাল ৯টার দিকে ডালিম ব্যবসায়িক কাজে তাকে মোবাইলে কল দেন। কিন্তু একাধিকবার কল দেওয়ার পরও সাড়া না পেয়ে তিনি বিষয়টি হোটেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। হোটেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী তার কক্ষের সামনে গিয়ে ‘Do Not Disturb’ লেখা ঝুলন্ত কার্ড দেখতে পেয়ে ফেরত যান।
পরবর্তী সময়ে বেলা পৌনে ১১টার দিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী ফের কক্ষের সামনে যান। দরজায় বারবার নক করেও সাড়া না পেয়ে বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানালে তাদের সন্দেহ হয়। বেলা ১১টার দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চকবাজার থানা পুলিশকে অবহিত করে। সাড়ে ১১টার দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পুলিশ কক্ষের দরজা খুলে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। মাথার পেছনে দু’টি আঘাতসহ রক্তাক্ত অবস্থায় মিকেল জেরিবা দরজার পাশে মেঝেতে পড়েছিলেন।
খবর পেয়ে বাদী পার্থ প্রতিম ঘোষ ঢাকা থেকে হোটেলে এসে তাদের প্রতিষ্ঠানের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার পোল্যান্ডের ওই নাগরিকের লাশ শনাক্ত করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, মরদেহ মেঝেতে চিৎ হয়ে শোয়া অবস্থায় তিনি দেখেন। বিছানা-বালিশ রক্তে ভেজা, টয়লেট এবং মেঝেও রক্তমাখা অবস্থায় দেখতে পান।
চকবাজার থানার ওসি মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠাই। সাধারণত লাশ ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত করা হয়। কিন্তু আমরা বিদেশি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে একটি বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্তের জন্য চিঠি দিই। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আমরা এখন প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি।’
মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্ত সম্পন্নের পর লাশ এখন মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় আইন প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর লাশ হস্তান্তর অথবা অন্য যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে ওসি জানান।
এদিকে, মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ আছে, হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাদী নিজেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করেন। ফুটেজে সর্বশেষ গত শনিবার অর্থাৎ ২ মার্চ বিকেল ৫টা ১২ মিনিটে কক্ষের দরজা খুলে হোটেল বয়কে একটি খালি খাবারের ট্রে এগিয়ে দিতে দেখা যায়। এ সময় হোটেল বয় ঘরের ভেতরে ঢোকেননি।
২ মার্চ বিকেল ৫টা ১২ মিনিট থেকে ৪ মার্চ সকাল পৌনে ১১টার মধ্যে যেকোনো সময় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিরা হোটেল কক্ষে ঢুকে তাকে খুন করে পালিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন বাদী পার্থ প্রতিম ঘোষ।
পুলিশ জানায়, ২ মার্চ বিকেল ৫টা ১২ মিনিট থেকে ৪ মার্চ সকাল পৌনে ১১টা পর্যন্ত ৪১ ঘণ্টারও কিছু বেশিসময় ঘিরেই তারা তদন্তের মূল প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট হোটেল কর্মীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘২ মার্চের আগের রাত ১২টা থেকে লাশ উদ্ধার পর্যন্ত- পুরো সময়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২ মার্চ দুপুর ২টার দিকে পোল্যান্ডের নাগরিক হোটেল কক্ষ থেকে বেরিয়ে ওই ফ্লোরেই হাউজকিপিং সেকশনে যান। সেখান থেকে তিনটি পানির বোতল নিয়ে তিনি আবার কক্ষে ঢোকেন। বিকেল ৪টার দিকে তিনি আবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবারের অর্ডার করেন এবং কক্ষে ফিরে আসেন। বিকেল ৫টা ১২ মিনিটে খাবারের কয়েকটি খালি প্লেট তিনি দরজা খুলে হোটেল বয়কে বাড়িয়ে দেন।’
তিনি বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, ৪১ ঘণ্টা ধরে তিনি হোটেলেই ছিলেন। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, তিনি হোটেলের কক্ষেই ছিলেন। আবার ২ মার্চ বিকেল ৫টা ১২ মিনিট থেকে ৪ মার্চ সকাল পৌনে ১১টা পর্যন্ত তার কক্ষেও কাউকে ঢুকতে দেখা যায়নি। তবে আমরা এটাও নিশ্চিতভাবে বলছি না যে, এই সময়ের মধ্যে কেউ সেখানে প্রবেশ করেনি। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আরও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করছি।’
এডিসি নোবেল চাকমা আরও বলেন, ‘২ মার্চ বিকেল ৫টা ১২ মিনিটে যে ওয়েটার তার কাছ থেকে খাবারের খালি প্লেট গ্রহণ করেছিলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি নিশ্চিত করেন যে, খালি প্লেটটি পোল্যান্ডের নাগরিকই এগিয়ে দিয়েছেন। তবে এ সময় ওয়েটারকে ভেতরে ঢুকতে হয়নি। আমরা সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন হোটেল কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’
ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখনও পর্যন্ত কাউকে চূড়ান্ত সন্দেহ বা শনাক্ত করতে পারিনি। তবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। দ্রুততার সঙ্গে বিদেশি নাগরিকের মৃত্যুরহস্য আমরা উদঘাটন করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পারব বলে আশা করছি।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম