Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কর্ণফুলীর মরা মাছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ‘চোখ বন্ধ’ প্রশাসনের

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ মার্চ ২০২৪ ২২:১৫

রাসায়নিকের প্রভাবে মরে যাওয়া মাছ নিয়ে কর্ণফুলীর তীরে রীতিমতো উৎসব চলছে। অথচ জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এই মাছ শরীরের জন্য হতে পারে মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। বুধবার কর্ণফুলীর তীর থেকে তোলা। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ৪৮ ঘণ্টা পরও জ্বলছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় অবস্থিত এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। সঙ্গে পুড়ছে টন টন অপরিশোধিত চিনি। সেসব চিনি পুড়ে, গলে আর বাষ্পীভূত হয়ে তৈরি করছে ক্ষতিকর রাসায়নিক, যা গিয়ে মিশে যাচ্ছে পাশের কর্ণফুলী নদীতে। এতে ছড়াচ্ছে দূষণ, তীরের দিকে নদীর পানি কালো হয়ে গেছে। রাসায়নিকের প্রভাবে কর্ণফুলী নদীতে রীতিমতো মরা মাছ ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

বুধবার (৬ মার্চ) সকাল থেকে নদীতে ভেসে ওঠা মরা ও দুর্বল হয়ে মৃতপ্রায় মাছ উৎসবের আমেজে সংগ্রহ করেছেন স্থানীয়রা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত এসব মাছ নদীতীরেই বেচাকেনা হয়েছে। এসব মাছ স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে বাজারেও বিক্রির জন্য গেছে।

অথচ জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এস আলম গ্রুপের চিনিকল থেকে গলিত অপরিশোধিত চিনির রাসায়নিক পানিতে মেশার কারণে বিষক্রিয়ায় এসব মাছের মৃত্যু হচ্ছে। ফলে এসব মরা মাছ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই মাছ খেলে বিষক্রিয়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া আশঙ্কা প্রবল।

আরও পড়ুন-

অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনের চোখের সামনেই মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব মাছ শিকার চললেও প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) ফিশ বায়োলজি ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুগারমিল থেকে নির্গত বর্জ্যগুলো নদী থেকে সাগরে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ এখন বৃষ্টি নেই, ঢল নেই, জোয়ারের তীব্রতা নেই। ফলে বর্জ্যগুলো নদীতেই জমা হয়ে আছে। এর প্রভাবে নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে।’

৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো এস আলমের চিনিকলের কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এই আগুন ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

‘নদীতে যেসব মাছ আছে, এসব রাসায়নিক প্রথমে মাছের ফুলকে আক্রমণ করেছে। এতে অক্সিজেন স্বল্পতা তৈরি হয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস আটকে গেছে। এরপর মাছের শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে এর রক্ত সঞ্চালন, হজম প্রণালী ও শক্তি তৈরির প্রক্রিয়া ধ্বংস করে দিয়েছে। এর ফলে দুর্বল হয়ে মাছ মারা যাচ্ছে। এসব মাছ যদি মানবশরীরে প্রবেশ করে, তাহলে কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা সহজেই অনুমেয়,’— বলেন ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

সোমবার বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর এলাকায় এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যদের চেষ্টায় রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে গত দুই দিনেও আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি। ওই কারখানার ভেতরে এখনো কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, যদিও ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এই আগুন আর ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই।

আগুনে কারখানার এক নম্বর গুদামে রাখা প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে গেছে বলে ভাষ্য এস আলমের। গলিত চিনি ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানির সঙ্গে মিশে তরল আকারে সংলগ্ন খাল-নালা হয়ে গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে।

এস আলমের চিনিকল থেকে বের হচ্ছে অপরিশোধিত চিনি গলে, পুড়ে তৈরি ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা জানিয়েছিলেন, ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অপরিশোধিত চিনিগুলো গলে যায়, যা মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের একটি যৌগ। গলে গিয়ে চিনিগুলো ভোলাটাইল কেমিক্যালে (ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক) পরিণত হয়।

গলিত চিনির ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক মিশে একদিনের ব্যবধানে সুগারমিলসংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর পানি লালচে রঙ ধারণ করে। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) ভোর থেকে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর এলাকায় নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মাছ ভেসে উঠতে থাকে। দুর্বল হয়ে মৃতপ্রায় অনেক মাছও ভেসে আসতে থাকে। এর মধ্যে আছে টেংরা ও গলদা চিংড়ি। এ ছাড়া কাঁকড়াসহ আরও জলজ প্রাণী মরে পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয়রা।

বুধবার সকাল থেকেই কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তের নানা বয়সী লোকজন নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরতে শুরু করেন। শত শত মানুষের উপস্থিতিতে ওই এলাকা রীতিমতো মাছ ধরার উৎসবস্থলে পরিণত হয়। নদীতে নোঙর করে রাখা ফিশিং ট্রলার ও লাইটারেজ জাহাজ থেকেও জাল মেরে মাছ ধরতে দেখা যায়। এসব জাহাজে থাকা নাবিক ও শ্রমিকরা সাধারণত সেখানেই রান্না করে খান।

চিনিকল থেকে বের হওয়া রাসায়নিকে মরছে মাছ। সেগুলো ধরছেন স্থানীয়রা। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

সকাল ১১টার দিকে বাংলাবাজার এলাকায় মাছ সংগ্রহ করে তীরে আসেন ফেরদৌস শেখ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা। তীরে উৎসুক কয়েকজন সেই মাছ কেনার জন্য ভিড় করেন। তবে ফেরদৌস তাদের আগ্রহে সাড়া দেননি। ফেরদৌস শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩০টার মতো ট্যাংরা আর চিংড়ি পেয়েছি। এগুলো আমি বেচব না। ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, আমরা খাব।’

এসব মাছকে ঝুঁকিপূর্ণ অভিহিত করে ক্যানসার রোগতত্ত্ববিদ ও ইউনিভার্সিটি অব সায়েয়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সাবেক উপাচার্য ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিনির রাসায়নিক বর্জ্য মাছের শরীরে প্রবেশ করেছে বলেই মাছগুলোর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে— এটি সঠিক। অর্থাৎ মাছের অপমৃত্যু হয়েছে। এসব মাছ সাধারণত না খাওয়াই উচিত। গরম পানিতে সেদ্ধ করার ফলে মাছের শরীরে থাকা অনেক রাসায়নিক ভেঙে যায় কিংবা ক্ষতি করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। কিন্তু সব রাসায়নিকের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।’

‘এখন মানবশরীরে ঢুকে বিষক্রিয়ায় সক্ষম রাসায়নিকসহ মাছ যদি কেউ খায়, তাহলে তার অন্ত্র, ফুসফুস, শ্বাসনালী, লিভার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার সেসব রাসায়নিক মানবশরীরে ক্যানসারের প্রভাবক এবং উদ্দীপক হিসেবেও কাজ করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে ক্রনিক লিভার ডিজিজ, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ নানা রোগ হতে পারে, যা পরে ক্যানসারেও পরিণত হতে পারে,’— বলেন ডা. প্রভাত।

যে যেভাবে পারছেন, কর্ণফুলী থেকে সংগ্রহ করছেন মাছ। তা চলে যাচ্ছে আশপাশের এলাকার বাজারগুলোতেও। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. সুশান্ত বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব মাছ যারা নিচ্ছে, তারা নিশ্চয় খাওয়ার জন্য নিচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়বে মানবদেহে। মাছের দেহে যে টক্সিন গেছে, সেই টক্সিন তো সরাসরি মানবদেহে যাবে। কিছু কিছু টক্সিন আছে, যেগুলো গরম পানিতে সেদ্ধ হওয়ার পরও কার্যকারিতা হারায় না। এমন মাছ যদি কেউ খায়, তাহলে প্রথমেই অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হবে। পেটের পীড়া হবে। লিভার ও কিডনি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে।’

সিভাসুর ফিশ বায়োলজি ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটা কথা আছে— গুড ওয়াটার, গুড ফিশ। এখন দূষিত পানির মাছ খেলে মানবদেহে প্রতিক্রিয়া তো হবেই। সাধারণত শিল্প কারখানার বর্জ্যের মিশ্রিত পানির মাছ খেলে মানবশরীরে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, জিংক, লেডসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক প্রবেশ করার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ ধরনের মাছ আমরা না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে কর্ণফুলী নদীতে যেসব মাছ ভেসে উঠছে, সেগুলো খেলে মানবদেহে রাসায়নিক বিষক্রিয়া তৈরি হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় ডায়রিয়াসহ শরীরে আরও নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবেশ অধিদফতরের উচিত ছিল এসব মাছ ধরতে সবাইকে নিরুৎসাহিত করা এবং প্রয়োজনে বাধা দেওয়া। এ ছাড়া দ্রুততার সঙ্গে ভেসে ওঠা মাছ সংগ্রহ করে সেগুলোকে দাফন করে ফেলা উচিত ছিল।’

মরা আর ভেসে ওঠা মাছ সংগ্রহে কর্ণফুলীর তীরে রীতিমতো চলছে মাছ উৎসব। অথচ এসব মাছ খেলে লিভার, কিডনি, ফুসফুসসহ নানা অঙ্গ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞরা। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

বিপুল পরিমাণ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ সংগ্রহ করা হলেও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, পরিবেশ অধিদফতর, জেলা মৎস্য অফিসকে প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগই নিতে দেখা যায়নি।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্ষতিকর মাছ ধরার বিষয়টি জানতে পেরে আমরা থানাকে অবহিত করেছি। তাদের এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরও পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে।’

জানতে চাইলে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জহির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা মাছ ধরছে তাদের তো আটক-গ্রেফতার করতে পারি না। এমন কোনো বিধান তো নেই। তবে আমরা বিট অফিসারের মাধ্যমে তাদের সচেতন করছি, যেন তারা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছগুলো সংগ্রহ না করেন। নদীর তীরে আমাদের টিম অবস্থান করছে।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আগুন এস আলম কর্ণফুলী নদী কর্ণফুলীর মাছ চিনি কারখানায় আগুন ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক নদী দূষণ পানি দূষণ ফায়ার সার্ভিস মরা মাছ রাসায়নিক পদার্থ স্বাস্থ্যঝুঁকি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সালমান শাহ্‌ স্মরণে মিলাদ মাহফিল
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:০৩

নাফ নদীর মোহনায় ২ শিশুর মরদেহ উদ্ধার
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৯

সম্পর্কিত খবর