ঢাকা: এস আলম গ্রুপের চিনিকল থেকে আগুনে পোড়া চিনির রাসায়নিক বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে নিষ্কাশন মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপ না নিলেও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে একটি তদন্ত কমিটি করেছে পরিবেশ অধিদফতর।
রাসায়নিক বর্জ্যের প্রভাবে পানি দূষিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গত দুদিন ধরে বিপুল মাছসহ জলজ প্রাণী মরে ও অর্ধমৃত অবস্থায় ভেসে উঠলেও পরিবেশ অধিদফতর ছিল নির্বিকার। অবশেষে আগুন লাগার তিন দিন পর বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকার মূল কার্যালয় থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাসকে কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ সদস্য রাখা হয়েছে দুজন— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ইনস্টিটিউট অব রিভার হারবার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. আসিফুল হক।
আরও পড়ুন- এস আলমকে নদীতে বর্জ্য না ফেলার নির্দেশ দিয়েই ‘প্রশাসন খালাস’
এ ছাড়া পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের উপপরিচালক মো. কামরুল হাসান ও জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ারকে তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
কমিটিকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনে আরও সদস্য যুক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতর, ঢাকার মহাপরিচালক ড. আব্দুল হামিদ।
এ সংক্রান্ত অফিস আদেশে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণ, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণের পাশাপাশি ক্ষতির প্রশমন ও প্রতিরোধে সুপারিশ করতে বলা হয়েছে কমিটিকে।
আরও পড়ুন- কর্ণফুলীর মরা মাছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ‘চোখ বন্ধ’ প্রশাসনের
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম গবেষণাগারের উপপরিচালক মো. কামরুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত বসে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করব।’
গত সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর এলাকায় এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এক নম্বর গুদামে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যদের চেষ্টায় রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এখন আগুন প্রায় নিভে এসেছে।
ঘটনাস্থলে থাকা চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘৮০ শতাংশ আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। ২০ শতাংশ আগুন নেভানো যায়নি। মাঝে মাঝে টিনের ফাঁকে কিংবা মালামালের ফাঁকে একটু করে দেখা যাচ্ছে। সেটা আমরা দ্রুত পানি ছিটিয়ে নিভিয়ে ফেলছি। রাতের মধ্যেই আগুন পুরোপুরি নেভানোর টার্গেট আছে আমাদের। এখন মূলত আগুন নেভানোর চেয়েও আমাদের ডাম্পিং কাজ বেশি করতে হচ্ছে।’
আগুনে কারখানার এক নম্বর গুদামে রাখা প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে গেছে বলে এস আলমের ভাষ্য। গলিত চিনি ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানির সঙ্গে মিশে তরল আকারে সংলগ্ন খাল-নালা হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ে। এ নিয়ে তোলপাড় হলেও তা মোকাবিলায় পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের কোনো তোড়জোড় গত তিন দিন দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন-
- ২০ ঘণ্টাতেও নেভানো যায়নি চিনিকলের আগুন
- চিনিকলের আগুন নিয়ন্ত্রণে, নেভাতে সময় লাগবে
- এস আলম’র আগুন: এক রাতেই অস্থির চিনির বাজার
- চিনিকলের বিষাক্ত তরলে কর্ণফুলীতে ভেসে উঠছে মরা মাছ
- চিনিকলের আগুনকে পুঁজি করতে পারে ব্যবসায়ীরা: এস আলম
- চিনির রাসায়নিক-ছাইভস্ম মিশে হুমকিতে কর্ণফুলীর জীববৈচিত্র্য
- ২ দিনেও নেভেনি আগুন, ছড়ানোর শঙ্কা নেই বলছে ফায়ার সার্ভিস
- এস আলম’র মিলে আগুন: পুড়ছে রোজার জন্য আমদানি করা চিনি
- চিনিকলে এখনও আগুন জ্বলছে, যোগ দিয়েছে সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ারও প্রথমবারের মতো ঘটনাস্থলে যান। তবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা জানিয়েছিলেন, ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অপরিশোধিত চিনিগুলো গলে যায়, যা মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের একটি যৌগ। গলে গিয়ে চিনিগুলো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকে পরিণত হয়।
গলিত চিনির ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক মিশে একদিনের ব্যবধানে সুগার মিলসংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর পানি লালচে রঙ ধারণ করে। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাত থেকে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর এলাকায় নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মাছ ভেসে উঠতে থাকে। দুর্বল হয়ে মৃতপ্রায় অনেক মাছও ভেসে আসতে থাকে। এর মধ্যে আছে- টেংরা ও গলদা চিংড়ি। এ ছাড়া কাঁকড়াসহ আরও জলজ প্রাণী মরে পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গত দুই দিনে তারা কর্ণফুলীতে ১১ প্রজাতির মাছ মৃত অথবা অর্ধমৃত অবস্থায় ভেসে আসতে দেখেছেন। এগুলো হলো— চিংড়ি, টেংরা, লাল চেঁউয়া, কুকুরজিভ, ছটা বেলে, লেজেপোয়া, বস্তাপোয়া, দেশি বেলে, দাঁতিনা কোরালের বাচ্চা, টেকচান্দা ও কাঁকড়া।
কর্ণফুলী নদী ঘুরে এসে প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, দূষণের কারণে নদী ও এর তীরে জলজ ও স্থলজ মিলিয়ে ৫২৮ প্রজাতির সঙ্গে ৮১ প্রজাতির বিপন্ন উদ্ভিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।