সকাল থেকে ২ সিটিতে ‘নির্দলীয়’ ভোট
৮ মার্চ ২০২৪ ২৩:৩১
ঢাকা: ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) দ্বিতীয় নির্বাচনের অপেক্ষা ফুরিয়ে এসেছে। রাত পোহালেই নগরবাসী ভোট দেবেন দ্বিতীয় মেয়াদের নগরপিতা নির্বাচনের জন্য। এদিকে একই সময়ে শুরু হবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) উপনির্বাচনও। এই সিটির তৃতীয় নির্বাচনে আরফানুল হক রিফাত প্রথমবার কোনো আওয়ামী লীগ নেতা জয় পেয়েছিলেন মেয়র হিসেবে। তার মৃত্যুতে এই সিটির বাকি মেয়াদের জন্য নতুন করে মেয়র নির্বাচন করতে হবে কুমিল্লা নগরবাসীতে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সাধারণত দলীয় প্রতীকেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে দেশেষর প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি গত কয়েক বছরের মতো এবারও নির্বাচন বর্জন করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এই দুই সিটির কোনোটিতেই মেয়র পদে কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেয়নি। ফলে দুই সিটিতে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ভোটে অংশ নিলেও কেউ দলের নৌকা প্রতীক পাননি। তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। দুই সিটির মধ্যে কেবল ময়মনসিংহে জাতীয় পার্টি একজন দলীয় প্রার্থী দিয়েছে। সে হিসেবে এই দুই সিটির নির্বাচনকে অনেকটাই নির্দলীয় নির্বাচন বলা যেতে পারে।
শনিবার (৯ মার্চ) সকাল ৮টা থেকে দুই সিটি করপোরেশনে ভোট দেবেন নগরবাসী। ভোট চলবে একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এর মধ্যে কুমিল্লা উপনির্বাচনে ভোট হবে কেবল মেয়র পদে। আর ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদের পাশাপাশি ৩২টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হবে। একটি সাধারণ ওয়ার্ডে একজন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন উপনির্বাচন
কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। বাস প্রতীকে ভোট করছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা তাহসীন বাহার সূচনা, হাতি প্রতীকে ভোট করছেন মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমান মাহমুদ।
এই সিটিতে মেয়র পদে বাকি দুই প্রার্থীই বিএনপি নেতা— মনিরুল হক সাক্কু (দেয়াল ঘড়ি প্রতীক) ও নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া প্রতীক)। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে তারা দুজনেই দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, এখনো বহিষ্কৃত নেতা হিসেবেই নির্বাচন করছেন। দুজনের মধ্যে সাক্কু এই সিটির প্রথম দুই মেয়াদের নির্বাচিত মেয়র। তৃতীয় নির্বাচনে তাকে হারিয়ে প্রয়াত আরফানুল হক রিফাত জয় পেয়েছিলেন।
কুমিল্লা সিটির সর্বশেষ নির্বাচনের তথ্য বলছে, সেবার সাক্কুকে মাত্র ৩৪৩ ভোটে হারিয়েছিলেন রিফাত। ওই নির্বাচনে রিফাত পেয়েছিলেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট, ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলা সাক্কু পেয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। আর সাক্কুর দল বিএনপিরই আরেক প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার পেয়েছিলেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট।
স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীসহ রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত, কুমিল্লা সিটিতে মেয়র পদে সাক্কুর হ্যাটট্রিক জয়ের পথে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিফাত নয়, ছিলেন কায়সার। ঘোড়া প্রতীকে তার ঝুলিতে যে ২৯ হাজার ভোট ছিল, তিনি প্রার্থী না হলে এর সিংহভাগই যেত সাক্কুর ঝুলিতে। সেক্ষেত্রে সাক্কুর পক্ষে কুমিল্লা সিটিতে টানা তৃতীয় জয় অস্বাভাবিক ছিল না।
এবারের উপনির্বাচনেও সাক্কুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দুই আওয়ামী লীগ নেতার পাশাপাশি কায়সার প্রার্থী হয়েছেন। তাতে সাক্কুকে গত নির্বাচনের মতোই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে বলে ধারণা ভোটারদের। যদিও সাক্কু বলছেন, কায়সারসহ তার প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে ভোটাররা তাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।
এদিকে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ছিলেন রিফাত। তবে এবারে দলীয়ভাবে একক কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় মাঠ ছিল উন্মুক্ত। সে সুযোগে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন অনেকেই। তবে শেষ পর্যন্ত সেই সংখ্যা ঠেকেছে দুইয়ে। এর মধ্যে তাহসীন বাহার সূচনা স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের মেয়ে।
কুমিল্লা সিটির ভোটের হিসাবে সবসময়ই বলা হয়, বাহার পরিবার যার পক্ষে, সেই প্রার্থীর ভোটে জয় নিশ্চিত। এবার বাহারকন্যা নিজেই প্রার্থী হওয়ায় তার পক্ষে ভোটের পাল্লা ভারী থাকবে বলেই ধারণা সাধারণ ভোটারদের। তবে দলের আরেক প্রার্থী নূর উর রহমান মাহমুদ ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে পরিচিত হওয়ায় তিনিও ভোটের মাঠে ছেড়ে কথা বলবেন না।
ভোটারাসহ রাজনীতি সচেতন মহলের অভিমত, এই নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সূচনা ও সাক্কুর মধ্যে। দুজনের ক্ষেত্রেই তাদের নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা কতটুকু ভোট ‘কাটতে’ পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে চূড়ান্ত ফলাফল।
কুসিক উপনির্বাচনে মোট ভোটার দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ১৮ হাজার ১৮২, নারী ভোটার এক লাখ ২৪ হাজার ২৭৪ জন, হিজড়া ভোটার রয়েছেন দুজন। ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে স্থায়ী ভোটকক্ষ ৬১৬টি, অস্থায়ী ভোটকক্ষ ২৪টি।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে দল থেকে কাউকে মনোনয়ন না দেওয়ার সুযোগে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের চার নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন এই সিটির প্রথম মেয়র ইকরামুল হক টিটু। ঘড়ি প্রতীকে নির্বাচন করছেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতা বাকি তিন প্রার্থী হলেন— এহতেশামুল আলম (ঘোড়া), অ্যাডভোকেট সাদেকুল খান মিল্কি টজু (হাতি) ও ড. রেজাউল হক (হরিণ)। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি এই সিটিতে প্রার্থী করেছে শহীদুল ইসলাম স্বপন মন্ডলকে।
ইকরামুল হক টিটু দ্বিতীয় নির্বাচনেও জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। এই সিটির প্রথম মেয়র হিসেবে তিনি যেসব কাজ করেছেন, তার প্রতিদান হিসেবেই ভোটাররা তাকে ভোট দেবেন বলে মনে করছেন তিনি। তবে তাকে নিয়ে ভোটারদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারও কারও মতে, সিটির প্রথম মেয়র হিসেবে তিনি যথেষ্ট কাজ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মেয়র টিটুর পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব ছিল, সেগুলো তিনি করতে পারেননি। বিশেষ করে শহরের যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে তাকে খুব একটা সফল মনে করছেন না অনেকেই।
এদিকে নির্বাচনে মেয়র টিটুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাতীয় পার্টির শহীদুল ইসলামের তুলনায় দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই বেশি শক্তিশালী মনে করছেন ভোটাররা। তারা বলছেন, এহতেশামুল আলম, অ্যাডভোকেট সাদেকুল খান মিল্কি টজু ও ড. রেজাউল হক— তিন আওয়ামী লীগ নেতারই রয়েছে পরিচ্ছন্ন ইমেজ। সে কারণে তারা ইকরামুল হক টিটুর ভোট কাটতে পারেন। স্থানীয় রাজনীতির মারপ্যাচে শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ টিটুকে ছাপিয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে ৩৩টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১২৮টি। ভোটকক্ষ ৯৯০টি। ভোট নেওয়া হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)।
এই সিটিতে ৩৩টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৬৪ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। যাচাই-বাছাই ও আপিল শেষে বৈধ প্রার্থী ছিলেন ১৫৮ জন। এর মধ্যে ৯ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে ৩৩ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ১৪৯ জন। এর মধ্যে ১১ নম্বর ওয়ার্ডে কেবল ফরহাদ আলমের মনোনয়নপত্রই বৈধ হওয়ায় তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ভোট হবে ৩২টি ওয়ার্ডে।
এদিকে ১১টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ৬৯ জন। তাদের কারও মনোনয়নপত্রই যাচাই-বাছাইয়ে বাতিল হয়নি। তাদের কেউ প্রার্থিতাও প্রত্যাহার করেননি। ফলে ৬৯ জনের সবাইই ভোটের মাঠে লড়াই করবেন।
প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, শুক্রবার (৮ মার্চ) সকাল ১১টা থেকে দুই সিটিতেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনি সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। দুপুর ২টার মধ্যেই এ কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। সুষ্ঠু ভোটের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হযেছে বলেও জানিয়েছেন নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন চৌধুরী জানান, ভোটের মাঠে পর্যাপ্ত র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবেন। ৩৩টি মোবাইল টিমসহ ১৭টি স্ট্রাইকিং টিমে এক হাজার ৩৪৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।
মেশিন নষ্ট হলেও যেন ভোটারদের ভোটদান প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন রাখা যায়, সেটি নিশ্চিত করতে ভোট কক্ষের দেড় গুণ ইভিএম দেওয়া হয়েছে বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।
কুমিল্লার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশনের ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে পাঁচজন করে পুলিশ সদস্য ও ১২ জন করে আনসার সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মোবাইল টিম কাজ করবে। নির্বাচনে প্রতি তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া পুরো সিটিতে ১২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে। র্যাবের টিম মোতায়েন থাকবে ২৭টি, পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে ২৭টি, সাধারণ স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে দুটি।
সারাবাংলা/টিআর
ইকরামুল হক টিটু এহতেশামুল আলম কুমিল্লা সিটি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন কুসিক উপনির্বাচন ড. রেজাউল হক তাহসীন বাহার সূচনা নিজাম উদ্দিন কায়সার নির্বাচন কমিশন নূর উর রহমান মাহমুদ মনিরুল হক সাক্কু ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচন মসিক নির্বাচন শহীদুল ইসলাম স্বপন মন্ডল সাদেকুল খান মিল্কি টজু