Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোজার আগের দিন চট্টগ্রামের বাজারে ‘যেমন খুশি তেমন হাঁকো’

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১১ মার্চ ২০২৪ ২২:২২

প্রথম রমজানের আগের দিন চট্টগ্রামে নিত্যপণ্য, বিশেষ করে রোজার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম বাড়তি পাওয়া গেছে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: রমজান শুরুর আগের দিন লেবু-শসা, চিনি-তেল, ছোলা থেকে শুরু করে গরু ও মুরগির মাংস, এমনকি কচুর লতির দামও বেড়েছে চট্টগ্রামের বাজারে। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন যে বিক্রেতারা যার কাছে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই দাম হাঁকছেন। কোনো পণ্য বিক্রি করে ঠিক পরের ক্রেতার কাছেই একই পণ্যের দাম ১০-২০ টাকা বেশি হাঁকতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের।

খোদ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাই অভিযানে গিয়ে এমন চিত্র দেখেছেন। একেকজনের কাছে একেক দাম কেন— এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই বিক্রেতাদের কাছে। তবে অজুহাতেরও অভাব নেই। দোকানগুলোতে টাঙানো হয়নি মূল্য তালিকা-ক্রয় রশিদ। এর ফলে যে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই ভোগ্যপণ্যের বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে রোজার আগের দিন সোমবার (১১ মার্চ) বাজারে গিয়ে রীতিমতো মাথায় হাত সাধারণ ক্রেতাদের। ক্ষোভ ঝেড়েছেন, নানা প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু জবাব দেওয়ার কাউকে পাননি তারা।

রোজায় ইফতারের অন্যতম প্রধান উপকরণ ছোলা। সোমবার রিয়াজউদ্দিন বাজারে এর দাম ছিল আগের সপ্তাহের চেয়ে ১০ টাকা পর্যন্ত বেশি। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

সোমবার নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, শাহপীর স্টোর ও মেহেরাজ স্টোরে সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশেই জগদীশ স্টোরে প্রতি লিটার ১৭০ টাকা এবং পাঁচ লিটার ৮০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল সয়াবিন তেল। অথচ সরকারিভাবেই খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৩ টাকা, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৯ টাকা এবং বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৮০০ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

শাহপীর স্টোরে ছোলা প্রতিকেজি ১০৮ টাকা, জগদীশ স্টোরে ১০৬ টাকা ও মেহেরাজ স্টোরে ১১০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাচ্চু স্টোরে ছোলা বিক্রি হতে দেখা গেছে মানভেদে ১০৫ থেকে ১০৮ টাকায়। অথচ এই বিক্রেতাই জানালেন, গত শনিবারও ৯৮ থেকে ১০১ টাকায় ছোলা বিক্রি করেছেন। বলছেন, রমজান উপলক্ষে পাইকারিতে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তাকেও দাম বাড়াতে হয়েছে।

এ ছাড়া শাহপীর স্টোরে পেঁয়াজ ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। মেহেরাজ স্টোরে চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ১৪৪ টাকায়।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাঁচাবাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি বিক্রি হতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে ইফতারের জন্য প্রয়োজনীয় শসা, লেবু, বেগুন ও কাঁচামরিচের দাম বাড়ানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। ওই বাজারে প্রতিকেজি শসা কোথাও কোথাও ৬০ টাকা, কোথাও ৬৭-৬৮ টাকা, আবার কোথাও ৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ গত সপ্তাহেও শসার দাম ৩৩-৩৪ টাকার মধ্যে ছিল বলে বিক্রেতারাই জানিয়েছেন।

সয়াবিন তেলের জন্য সরকার নির্ধারিত দাম রয়েছে। কিন্তু সোমবার সে দামে বিক্রি হতে দেখা যায়নি। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

লেবু রিয়াজউদ্দিন বাজারে প্রতিটি ১৪ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সন্ধ্যায় কাজির দেউড়ি বাজারে বিক্রি হয়েছে প্রতিটি লেবু ২০ টাকায়। অথচ আগের সপ্তাহেও এর দাম ছিল মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকা।

বেগুন বিক্রি হচ্ছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। অথচ গত বৃহস্পতিবারও বেগুনের দাম ৩০ টাকার মধ্যে ছিল। কাঁচামরিচ বাজারভেদে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে।

নগরীর কর্নেলহাট এলাকা থেকে সস্তা দামে কেনার আশায় রিয়াজউদ্দিন বাজারে এসেছিলেন গৃহিণী কোহিনূর আক্তার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছোট পেঁয়াজ গত সপ্তাহেও কর্নেলহাটে কেজি ৮০ টাকায় কিনেছি। কম দামে পাব ভেবে রিয়াজউদ্দিন বাজারে পাইকারি আড়তে এসেছি। এখানে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে। শসা ৭০ টাকা করে কিনতে হয়েছে। কর্নেলহাট থেকে গাড়িভাড়া হিসেব করলে এখানে এসে আরও লস হয়েছে।’

আরেক ক্রেতা এস এম মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়তি। রমজান এলেই এটা শুরু হয়ে যায়। যে বেগুন ৩০ টাকা বেচে, সেটা এখন ৬০ টাকা, একটু ভালো মানেরটা ৮০ টাকা। কচুর লতি কয়েকদিন আগেও ৪০ টাকায় কিনেছি। এখন ৬০ টাকা। এর কোনো অর্থ আছে? কচুর লতির দামও কেন বাড়তে হবে? কাকে দোষ দেবো? কার দোষ ধরব? নিজেকেই দোষ দিই। শুধু বড় বড় কথা শুনি, বাজারটা ঠিক করতে পারে না কেউ।’

পেঁয়াজ, শসা, লেবু— রোজায়, বিশেষ করে গরমের দিনের রোজায় এসব পণ্যের চাহিদা একটু বেশিই থাকে। সেই ‘সুযোগে’ বাজারে এগুলোর দামও বেড়ে গেছে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

এ অবস্থায় সোমবার সকালে রিয়াজউদ্দিন বাজারে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে শুধু লেবু ও শসা বিক্রেতাদের জরিমানা করেই দায় সেরেছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

মূল্য তালিকা ও কেনা-বেচার ভাউচার না রাখায় এবং বাড়তি দামে লেবু বিক্রি করায় মেম্বার বাণিজ্যালয়কে ৫০ হাজার টাকা ও মাগুরা বাণিজ্যালয়কে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বাড়তি দামে শসা বিক্রির দায়ে মিতালী বাণিজ্যালয়কে ১৫ হাজার টাকা ও বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়কে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

অভিযানে যাওয়া অধিদফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্ল্যাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে রিয়াজউদ্দিন বাজারে ৬-৭ টাকায় প্রতিটি লেবু বিক্রি হতে দেখেছি। আজ ১২-১৩-১৪ টাকায় বিক্রি করছে। যে শসা গত সপ্তাহে প্রতিকেজি ৩৩-৩৪ টাকায় বিক্রি হতে দেখেছি, সেটি এক জায়গায় ৬০ টাকা, আরেক জায়গায় ৬৭ টাকায় বিক্রি হতে দেখেছি। আবার একই বিক্রেতা ৭০ টাকাও দাম চাচ্ছেন। তবে আমরা আসার পর ৫০ টাকায় নামিয়ে আনেন।’

সোমবার বাজারে অভিযান চালান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। তবে সে অভিযান সীমাবদ্ধ ছিল লেবু-শসার দোকানে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

‘আমরা বারবার বলেছি, মূল্য তালিকা এবং ক্রয়-বিক্রয়ের রশিদ রাখতে। তারা কোনো ভাউচার রাখেন না, রাখলেও আমাদের দেখান না। আসলে ভাউচার না রাখলে তাদের একটা সুবিধা হয়। তারা বলতে পারে যে তারা পণ্য বেশি দামে কিনেছেন। এ অজুহাত দিয়ে তারা পণ্যের দাম বাড়ায়। যত প্রতিষ্ঠানে এসেছি, একই চিত্র দেখেছি। যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে সেভাবে দাম নিচ্ছে। আমরা জরিমানা করেছি, সতর্ক করেছি। রমজানজুড়ে আমরা আমাদের অভিযান অব্যাহত রাখব,’— বলেন ফয়েজ উল্ল্যাহ।

রিয়াজউদ্দিন বাজার ব্যবসায়ী-আড়তদার সমিতির দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের বারবার বলি যে আপনারা কেনাবেচার রশিদ রাখবেন। আপনারা যে দামে কিনবেন, সেটার ওপর ১০-১৫ পারসেন্ট বাড়তি ধরে বিক্রি করবেন। কিন্তু উনারা সেটা শোনেন না। এখন ভোক্তা অধিকার এসে লেবু আর শসার অতিরিক্ত দাম পেয়েছে। কেনাবেচার রশিদ থাকলে, ব্যবসায়ীরা কথা বলতে পারতেন। তাদের কাছে যেহেতু সেটা নেই, বলারও কিছু নেই, জরিমানা দিতে হয়েছে।’

এদিকে রিয়াজউদ্দিন বাজারে মুরগির দাম প্রতি কেজিতে অন্তত ৩০ টাকা এবং গরুর মাংসের দাম অন্তত ১৫০ টাকা বেড়েছে।

সোমবার সকালে হাসান এন্টারপ্রাইজ নামে এক দোকানে ব্রয়লার মুরগি প্রতিকেজি ২২০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৫০ টাকা, লাল মুরগি (কক) ৩২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। মালিক মো. শফিক সারাবাংলাকে জানান, ফার্মের মুরগি গত সপ্তাহে ১৯০ টাকায় বিক্রি করেছেন। অন্য মুরগির দামও এ সপ্তাহে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। সরবরাহকারীরাই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে তার দাবি।

রমজান সামনে রেখে সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির দাম কেজিতে ৫০ টাকা আর গরুর মাংসের দাম কেজিতে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

রিয়াজউদ্দিন বাজারে সোমবার সকালে গরুর মাংস প্রতি কেজি হাড়সহ বিক্রি হয়েছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। প্রতি কেজি হাড় ছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৯৫০ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহেও হাড়সহ গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় এবং হাড় ছাড়া শুধু মাংসের দাম ছিল ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা।

ব্যবসায়ী জানে আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো খামার থেকে গরু কিনে জবাই করি। লাল গরু একেকটির দাম পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। গাড়ি ভাড়া, স্টাফের খরচ মিলিয়ে কিছু দাম আমাদের বাড়াতে হয়েছে। ভারত সীমান্ত দিয়ে এখন কোনো গরু আসে না। ভারতের গরু এলে বাজার এত চড়া থাকত না।’

মোহাম্ম ইসফাক নামে এক ক্রেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘খামারে গরুর দাম বাড়তি, ভারতের গরু আসছে না— এসব স্রেফ অজুহাত। আসলে রোজার কারণে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। খামার থেকে কসাই পর্যন্ত সবই একই সিন্ডিকেট। শসার কেজি ৬০-৭০ টাকা আর ৫ টাকার লেবু ২০ টাকায় বিক্রির কোনো যুক্তি আছে? সব জিনিসের দাম অতিরিক্ত। নিজেদের ইচ্ছামতো বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। মজুত করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, রোজার মাসে বেশি লাভ করবে— এটাই মানসিকতা।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

নিত্যপণ্যের দাম নিত্যপণ্যের বাজার বাজার বাজার নিয়ন্ত্রণ মূল্যবৃদ্ধি রমজান রিয়াজউদ্দিন বাজার রোজা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর