অবিবাহিত নারীর নামেও মাতৃত্ব ভাতা তুলে নেন ইউপি চেয়ারম্যান
১৮ মার্চ ২০২৪ ০৮:৩৯
নীলফামারী: ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অবিবাহিত নারীর নাম দিয়ে মাতৃত্বকালীন ভাতা’র টাকা আত্মসাৎ, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর), গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারসহ (কাবিখা) বিভিন্ন প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, ভুয়া রেজুলেশন করে ইউপি উন্নয়ন সহায়তা খাতে তিনটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না করে ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। আরও অভিযোগ রয়েছে, ৪০দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির তালিকাভুক্ত শ্রমিকদের কাছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করেন চেয়ারম্যান। টাকা দিতে না পারায় ৮ জন দক্ষ শ্রমিককে বাদ দেওয়া হয় ওই কর্মসূচি থেকে।
চেয়ারম্যানের এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ৪টি অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা। চেয়ারম্যানের এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের সত্যতা পাওয়া যায়।
এর আগেও ওই চেয়ারম্যানের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্থানীয়রা অভিযোগ ও পোস্টারিং করলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে জানা যায়, ইউনিয়নের ডালিয়া চাপানী উচ্চ বিদ্যালয়ের বেঞ্চ সরবরাহের জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দের বিষয়ে কিছুই জানতেন না প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ আজাদ। লোকমুখে বরাদ্দের বিষয়ে শুনে চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান সরকারকে জানানোর পর বেঞ্চ সরবরাহ বাবদ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিপরীতে ১৫ জোড়া কাঠের পুরাতন বেঞ্চ রাতারাতি স্কুলে পাঠায় চেয়ারম্যান।
প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ আজাদ বলেন, ‘স্কুলে বেঞ্চ সরবরাহের জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে জানতাম না। লোকমুখে শোনার পর বরাদ্দের বিষয়ে চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন একটি বরাদ্দ হয়েছে। এরপর ওইদিন সন্ধ্যায় ১৫ জোড়া পুরোনো কাঠের রং করা বেঞ্চ স্কুলে পাঠান তিনি।’
‘কাবিটা’ প্রকল্পের আওতায় তালতলা সার্বজনীন মন্দিরের মাটি ভরাট ও সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ টাকা। কিন্তু নামমাত্র কাজ করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান ও ওই প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য শাপলা বেগম। দুইলাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে সে বিষয়ে মন্দিরের সভাপতি-সেক্রেটারি জানেন না কেউই।
মন্দির কমিটির সদস্য গোকুল রায় বলেন, ‘আমরা কেউই জানি না কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে। একদিন ওয়ার্ড চেয়ারম্যান (ইউপি সদস্য) মন্দিরের মাঠে ৫-৬ ট্রলি মাটি এনে ফেলায়। আর লোহার দরজা লাগিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকাও খরচ হবে কি না সন্দেহ।’
এ বিষয়ে কথা হয় ওই ইউপি সদস্য শাপলা বেগমের সাথে। বরাদ্দ বাবদ মন্দিরের মাঠে ২৫ ট্রলি মাটি ফেলানোর দাবি তার। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান আমাকে প্রকল্প দিয়েছেন, সে অনুযায়ী কাজ করেছি আমি। মন্দিরে মাটি ভরাট বাবদ ২৫ ট্রলি মাটি ফেলেছি আর ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে মন্দিরের গেট বানিয়ে দিয়েছি।’
তার দেওয়া হিসেব অনুযায়ী মাটি ভরাট বাবদ ৩০ হাজার ও মন্দিরের দরজা তৈরি বাবদ ৮৫ হাজারসহ মোট ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা খরচ হলেও বাকি ৮৫ হাজার টাকার হিসেব দিতে গিয়ে গড়িমসি শুরু করেন তিনি।
অপরদিকে মাটি ভরাট ও সংস্কারের জন্য শুকানদিঘি পাড় সর্বজনীন মন্দিরেও বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ টাকা। এখানে মন্দিরের বরাদ্দের পরিমাণ কত সে বিষয়ে জানেন না মন্দির কমিটির সভাপতি দিলিপ কুমার রায়। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানের লোক এসে শুধু বলে একটা বরাদ্দ আছে। সেই বরাদ্দ দিয়ে মন্দির মাঠে মাটি ও ৬০ হাজার টাকা দিয়ে মন্দিরের একটি গেট বানিয়ে দেয়। কিন্তু দুই লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে তা আমরা জানি না। আমাদের মন্দিরে সর্বোচ্চ হলেও ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’
ওই ইউনিয়নের এরকম আরও অনেক প্রকল্পতেই রয়েছে সীমাহীন অনিয়ম। শুধুমাত্র প্রকল্পের টাকা আত্মসাতেই থেমে নেই চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি। মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। এমন প্রায় ১৪ জন ভুক্তভোগীদের দাবি, তালিকায় নাম থাকলেও সুবিধাভোগীরা ভাতা পাননি।
চেয়ারম্যান নিজস্ব এ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ তাদের। এমনকি গর্ভবতী নয় এমন নারীর নাম দিয়ে মাতৃত্বকালীন ভাতার টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এমনটিই হয়েছে তহুরা বেগম নামে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সাথে। তার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মাতৃত্ব ভাতা তোলার অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানে বিরুদ্ধে। অথচ ওই শিক্ষার্থীর এখনও বিয়েই হয় নি। শিক্ষার্থী নিজেও জানতেন না তার নামে তোলা হচ্ছে মাতৃত্বকালীন ভাতা।
ওই শিক্ষার্থী তহুরা বেগম বলেন, ‘আমি এখনও পড়াশোনা করছি। সন্তান তো দূরের কথা এখনও আমি অবিবাহিত। কিন্তু চেয়ারম্যান আমার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আমার নামে মাতৃত্বকালীন ভাতা তুলছেন। আমি এটি জানার সাথে সাথে চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছু না বলেই আমার ফোন কেটে দেন। তাই আমি উপায় না পেয়ে এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি অভিযোগ দিয়েছি।’
অপরদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউপি উন্নয়ন সহায়তা খাতে তিনটি প্রকল্প দেখিয়ে ৩লাখ ১৮ হাজার টাকার কাজ না করেই সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান সরকার। এ বিষয়েও চেয়ারম্যানের নামে নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দেন মঞ্জুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি।
মঞ্জুরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এলাকার উন্নয়নের জন্য যেসব বরাদ্দ দিচ্ছে চেয়ারম্যান তা নিজের উন্নয়নে লাগাচ্ছেন। ভুয়া রেজুলেশন করে নামমাত্র কাজ করে ইউপি উন্নয়ন সহায়তা খাত থেকে ৩লাখ ১৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।’
প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎের বিষয়ে কথা হয় ডিমলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তাবায়ন কর্মকর্তা মো. মেজবাহুর রহমান বলেন, ‘কাজ না করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করার সুযোগ নেই। যদি এমন হয়ে থাকে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চেয়ারম্যানের এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। এসব অনিয়ম তদন্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এমও