অভিযানে হুমকির মুখে রেস্তোরাঁ ব্যবসা, বেকারত্বের পথে ২ লাখ কর্মী
১৭ মার্চ ২০২৪ ২০:৩৪
ঢাকা: দিনাজপুরের একটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন মোহাম্মদ সোহেল রানা। বাবা বর্গাচাষি। তার পক্ষে সোহেলের পড়ালেখার খরচ জোগানো সম্ভব না। তাই নিজের পড়ালেখার খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে সোহেল তাই ঢাকায় ফুডপান্ডা সার্ভিসে খাবার ডেলিভারির কাজ করেন। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে খাবার ডেলিভারি করেন। এ থেকে মাসে আয় করেন ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। শুধু সোহেল রানা নয়, তার বড় ভাইও পড়ালেখার পাশাপাশি ফুডপান্ডাতেই খাবার ডেলিভারি করেন।
এদিকে, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ড ও এর জের ধরে বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সোহেল রানার ডেলিভারির সংখ্যাও কমে গেছে। এখন ঢাকায় বাসা ভাড়া দেওয়া ও বাড়িতে টাকা পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন তিনি। একই অনিশ্চয়তায় তার ভাইও। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দুই ভাইকে পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হবে বলে আশঙ্কার কথা জানাচ্ছেন সোহেল রানা।
ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন আয়ান আহমেদ। ঢাকাতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দেড়-দুই বছর হলো পড়ালেখার পাশাপাশি ফুডপান্ডায় খাবার ডেলিভারির কাজ করেন তিনি। অন্য কাজ খুঁজছিলেন, কিন্তু রুটিন অনুযায়ী সময় দেওয়া সম্ভব না বলেই এই কাজ বেছে নিয়েছেন। প্রতিদিন ছয় থেকে সাত ঘণ্টা খাবার ডেলিভারির কাজ করলে মাসে আট থেকে ৯ হাজার টাকা আয় হয় তার। অভিযানে ঢাকার রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ হতে থাকায় তার সেই আয়েও টান পড়েছে।
আয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেস্তোরাঁগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্ডার অনেক কমে গেছে। বেইলি রোডে কাচ্চি ভাইয়ের যে বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে, ওখান থেকে প্রায় অর্ধেক অর্ডার আসত। এখন তো ওই বিল্ডিং থেকে অর্ডার আসা একদম বন্ধ। আগে যেখানে অর্ডার সাপ্লাই করে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না, এখন সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অর্ডারের জন্য ওয়েট করতে হয়। এ রকম চলতে থাকলে আর ফুডপান্ডায় কাজ করা হবে না। অন্য কাজ খুঁজতে হবে। আমার ব্যাচের আরও চার জন ফুডপান্ডায় খাবার সাপ্লাই দেয়। আমি তো তাও ফ্যামিলির সঙ্গে থাকি। এই কাজ বন্ধ হয়ে গেলে ওদের মেসের ভাড়া তোলাই কষ্ট হয়ে যাবে।’
আরও পড়ুন: সারাদেশে ১ দিনের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধের হুমকি
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধ শতাধিক মৃত্যুর ঘটনার পর রাজধানীজুড়ে চলছে অবৈধভাবে গড়ে তোলা রেস্তোরাঁবিরোধী অভিযান। দুই সপ্তাহের অভিযানে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দুই শতাধিক রেস্তোরাঁ। আর এতেই হুমকির মুখে পড়েছে বিপুলসংখ্যক রেস্তোরাঁকর্মীর কর্মসংস্থান। রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শেফ, ওয়েটার বা নিরাপত্তারক্ষীরা যেমন কাজ হারাচ্ছেন, তেমনি কাজ হারাচ্ছেন ফুডপান্ডার মতো খাবার সরবরাহকারী অ্যাপের সরবরাহকারীরাও। আর তাদের বড় অংশই তরুণ, যারা পড়ালেখার পাশাপাশি এই কাজে নিয়োজিত। পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় এসব তরুণরা এই কাজ করেই নিজেদের পড়ালেখা চালিয়ে নিচ্ছেন। একের পর এক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে তাদের ভবিষ্যত।
সারাদেশে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় কত লোক যুক্ত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির কাছেও। তবে তাদের অনুমাননির্ভর তথ্য বলছে, সারাদেশে রেস্তোরাঁকর্মীর সংখ্যা আনুমানিক ৩০ লাখ। এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই লাখ কাজ করেন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। আর ঢাকায় কেবল খাবার সরবরাহের কাজেই যুক্ত প্রায় ৫০ হাজার রাইডার।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান জানান, এর বাইরেও আরও অন্তত দেড় লাখ কর্মী পরোক্ষভাবে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় যুক্ত। বিনা নোটিশে একের পর এক রেস্তোরাঁ বন্ধ করার ফলে শুধু মালিকরাই নয়, বিপদে পড়েছেন এসব কর্মীরাও।
ঢাকা শহরে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক গড়ে ওঠে রেস্তোরাঁ। এর অধিকাংশই আবাসিক ভবনে। এসব রেস্তোরাঁর অনুমতি পাওয়া ও চালু থাকার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়েও। রেস্তোরাঁগুলো চালু হওয়ার আগেই কেন এসব সংস্থা দেখেনি- সেই অভিযোগও অনেকের।
রেস্তোরাঁ মালিকদের দাবি, তারা প্রতিষ্ঠান চালুর আগে প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিয়েছেন। তারপরও রাজউক কর্মকর্তাদের নিয়মিত ঘুষ দিয়ে যেতে হয়। এখন একটি দুর্ঘটনার পর যেভাবে কোনো সময় না দিয়েই একের পর এক রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হচ্ছে, তাতে আরও অনেক মানুষের জীবিকা বন্ধ হয়ে পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
ইমরান হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্র যেন উৎসব শুরু করেছে। এভাবে একের পর এক অভিযান চলতে থাকলে ব্যবসাসংশ্লিষ্ট সবাই আক্রান্ত হবেন। রোজার মাসে ব্যবসা বন্ধ থাকায় বড় অঙ্কের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা। রেস্তোরাঁগুলো বন্ধের ফলে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগও এখন হুমকির মুখে।’
ইমরান আরও বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রের নিয়ম মেনেই ব্যবসা করতে চাই। তবে শুধু আমাদের ওপর কঠোর না হয়ে রাজউক ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিদেরও ধরা হোক, যারা টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁগুলোকেও বৈধতা দিয়েছেন।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছে, ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যবসায় অনুমোদন দেওয়ার আগে তারা সবকিছু যাচাই করেন। অনেকেই বাণিজ্যিক ঠিকানায় ব্যবসার অনুমোদন নিয়ে পরে আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ চালু করেন। আবার অনেকেই ঢাকার আশপাশের অন্য এলাকা থেকেও ট্রেড লাইসেন্স নেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট কাগজপত্র ও ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিপত্র পেলে তবেই বাণিজ্যের অনুমতি দেই। তবে অনেকেই ভিন্ন এলাকা থেকে এটি সংগ্রহ করে থাকেন।’
কাগজে দেওয়া ঠিকানা সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয় কি না?— জানতে চাইলে ডিএসসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী যাচাই করারই কথা। এ ক্ষেত্রে আমাদের পুরোপুরি গাফিলতি বলা যাবে না। কারণ, অনলাইন আবেদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাণিজ্য অনুমতি দিতে হয়। আমাদের লোকবল অনুযায়ী অনেক সময় একদিনের মধ্যে ঘুরে দেখা সম্ভব হয় না। এর সুযোগও অনেকে নিয়ে থাকতে পারেন।’
রাজধানীতে চলমান অভিযান নিয়ে আবু নাছের বলেন, ‘সাময়িকভাবে অনেকেই হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু এর মাধ্যমে রেস্তোরাঁ ব্যবসা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। অগ্নিনিরাপত্তা তো অবহেলা করা যায় না। এটি ঠিক করতেই হবে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অভিযানেও দেখা গেছে অনেক রেস্তোরাঁ ভুয়া ঠিকানা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। আবার অনেক রেস্তোরাঁর রাজউক অনুমোদন ও অগ্নিনিরাপত্তা সনদ নেই। এ ক্ষত্রে সেসব রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সরেজমিনে যাচাই-বাছাই করার পরেই ট্রেড লাইসেন্স সরবরাহ করা হয়। ট্রেড লাইসেন্সে বর্ণিত শর্তাবলী মেনে ব্যবসায় পরিচালনা করা হবে— এই শর্তেই অনুমতি দেওয়া হয়। ট্রেড লাইসেন্সের শর্ত মানা হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে ডিএনসিসির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেন এবং আইনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। বর্তমানে মেয়রের নির্দেশে অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ীই আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। কারও কর্মসংস্থান নষ্ট হোক, সেটি আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে আমরা চাই, সবাই একটা নিয়মের মধ্যে আসুক। মানুষের প্রাণহানি তো কারোরই কাম্য নয়। প্রতিটি ভবনে যেন অগ্নি ও অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক থাকে, সেটিই আমরা দেখছি। এগুলো ঠিক না পেলে তবেই আমরা রেস্তোরাঁ বন্ধ করছি। এসব রেস্তোরাঁ যদি সব ঠিকঠাক করে আবার চালু করতে চায়, তখন আমরা সেটা বিবেচনা করব।’
আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁর অনুমোদন দেওয়া কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ রাজউক নেবে কি না?— জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেন, ‘পুলিশের তদন্ত চলমান রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে আমাদের ৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় চারজনকে বরখাস্তও করা হয়েছে।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর/পিটিএম