Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ডিজুডে’ অর্ধকোটি পশুর মৃত্যু, মঙ্গোলিয়ায় খাদ্যসংকটের শঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৪ মার্চ ২০২৪ ১৬:২৬

মঙ্গোলিয়ায় গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর শীতকাল যাচ্ছে এবার। চরম ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে সেদেশে চলতি শীত মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ প্রানী মারা গেছে। হাজার হাজার মানুষের খাদ্য সরবরাহ ও জীবিকা  হুমকির মুখে পড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস এ বিষয়ে সতর্ক করেছে।

চরম এই আবহাওয়া মঙ্গোলিয়ার স্থানীয় ভাষায় ‘ডিজুড’ নামে পরিচিত। যখন নিম্নমুখী তাপমাত্রা এবং গভীর তুষার ও বরফে চারণ এলাকা ঢেকে যায় তখনকার পরিস্থিতিকে ডিজুড বলে, যার অর্থ বিপর্যয়। ডিজুডের সময় গবাদিপশুর চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গোলিয়ার প্রায় তিন লাখ মানুষ ঐতিহ্যবাহী যাযাবর পশুপালক। খাদ্যের জন্য এমনকি বাজারে বিক্রি করে টাকা উপার্জনের জন্য গবাদিপশু, ছাগল ও ঘোড়ার উপর নির্ভরশীল তারা।

এশিয়া প্যাসিফিকের আইএফআরসি আঞ্চলিক পরিচালক আলেকজান্ডার ম্যাথিউ গত বৃহস্পতিবার সিএনএনকে বলেছেন, যারা বেঁচে থাকার জন্য গবাদিপশুর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল, তারা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন আর নিজেদের খাবারের জন্য বা বিরূপ আবহাওয়ায় ঘর গরম রাখতে সক্ষম নয়।

আইএফআরসি জানিয়েছে, গত নভেম্বর থেকে কমপক্ষে দুই হাজার ২৫০ পশুপালক পরিবার তাদের ৭০ শতাংশের বেশি গবাদিপশু হারিয়েছে। সাত হাজারের বেশি পরিবার এখন পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে ভুগছে।

ডিজুড দেশের তিন-চতুর্থাংশ এলাকাজুড়ে চরম পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শীত অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ম্যাথিউ বলেন, এখন বসন্তকাল। কিন্তু মঙ্গোলিয়ায় শীত চলছে। মাটিতে এখনও তুষার জমে আছে। গবাদি পশু এখনও মারা যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গোলিয়ার সরকার গত মাসে এই চরম আবহাওয়া মোকাবিলায় ‘উচ্চতর প্রস্তুতি’ অবস্থা ঘোষণা করেছে। এই রাষ্ট্রীয় সতর্ক পরিস্থিতি আগামী ১৫ মে পর্যন্ত বহাল থাকবে। এদিকে গত সপ্তাহে জীবিকা হারিয়েছে এমন মানুষদের দুর্ভোগ কমাতে তহবিলের জন্য দাতাদের কাছে আবেদন করেছে আইএফআরসি।

ম্যাথিউ বলেন, এমনকি উচ্চ স্তরের প্রস্তুতিতেও কাজ হচ্ছে না। এ বছর যেমন সরকার উচ্চ স্তরের প্রস্তুতির ঘোষণা করেছে তেমন গত বছর বা আগের বছরগুলোতেও এই অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। আসলে এই ঘোষণা এখনকার চরম পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত নয়। আমরা অনেক প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু ডিজুডের মাত্রা এখন আমাদের অবাক করে দিয়েছে।

ডিজুড পশুপালকদের অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অনেক মঙ্গোলিয়ান পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। এই আবহাওয়ায় সেখানে পর্যটন ভেঙে পড়েছে। বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে যারা গ্রামীণ এলাকার মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। ভারী তুষারপাতের কারণে রাস্তা-ঘাট তাদের জন্য বন্ধ।

এ বছরের ডিজুড এত খারাপ কেন

পশুপালক পরিবারগুলো সাধারণত ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। গবাদি পশু চরানোর জন্য নতুন চারণভূমি খুঁজতে দেশের বিস্তীর্ণ তৃণভূমিজুড়ে ভ্রমণ করে তারা। শীতকালে পশু বাঁচিয়ে রাখতে তারা গ্রীষ্মকালে পশুখাদ্য, ঘাস এবং ফসল ফলায়।

মঙ্গোলিয়ানরা চরম শীতে অভ্যস্ত। কিন্তু ডিজুড আসলে বিপর্যয় নামে। কারণ যে বছর ডিজুড আসে, সে বছরের গ্রীষ্মকালেও খাবার সংকট থাকে। কারণ ভারী তুষারপাত এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে গ্রীষ্মকালে খরা হয়। তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রির কম থাকে সর্বদা।

মঙ্গোলিয়ায় এই বছরের তুষারপাত ৪৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গত জানুয়ারিতে দেশটির ৯০ শতাংশ এলাকায় তুষারপাত হয়েছে।

গত বছরের গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। তাই গ্রীষ্মকাল ভালোই কেটেছিল। কিন্তু শীতকাল আসার আগেই হঠাৎ তাপমাত্রা তীব্রভাবে কমে যায়। নভেম্বরের প্রথম দিকে প্রচুর তুষারপাত হয়। এর মধ্যে হঠাৎ আবার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে তুষার গলতে থাকে। পরে আবার যখন শীত বাড়তে থাকে তখন তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রিরও নিচে নেমে যায়।

এর ফলে চারণভূমিতে ঘাস-লতাপাতা যথেষ্ট জন্মাতে পারেনি। তাই শীতের আগে গবাদিপশু পর্যাপ্ত খেয়ে মোটাতাজা হতে পারেনি। পশুপালকরাও শীতকালে গবাদিপশুর জন্য যথেষ্ট খড় জমাতে পারেনি।

এখন মঙ্গোলিয়া দ্বৈত—শ্বেত ও লৌহ— দুই ধরনের ডিজুডের কবলে পড়েছে। এর অর্থ হলো, খুব বেশি তুষারপাতের কারণে প্রানীরা তৃণভূমিতে যেতে পারছে না, আবার তৃণভূমিও ভারী বরফস্তরে ঢাকা।

গত কয়েক বছর ধরে মঙ্গোলিয়ায় ঘন ঘন ডিজুড পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। তাই চারণভূমি এবং পশুপালকরা একবারের ক্ষতি পুষাতে অবসর পাচ্ছেন না।

আইএফআরসি-এর ম্যাথিউ বলেন, আসলে ডিজুড চক্রাকারে হয়ে থাকে, ইদানিং এর সংখ্যা বেড়েছে। গত ১০ বছরে ছয়বার হয়েছে ডিজুড। এর মধ্যে এবারের ডিজুড সবচেয়ে খারাপ। আগে বেশ কয়েক বছর পর পর ডিজুড ঘটত। কিন্তু এখন ঘন ঘন ঘটছে, ফলে ক্ষতি কাটিয়ে উঠার সময় পাওয়া যাচ্ছে না।

জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) মতে, জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি মঙ্গোলিয়া। গত ৭০ বছরে দেশটির গড় তাপমাত্রা ২.১ ডিগ্রি বেড়েছে।

ইউএনডিপির মতে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটির চার স্বতন্ত্র ঋতু ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বারবার গ্রীষ্মকালীন খরা হচ্ছে এবং পরবর্তীতে শীতকাল হয়ে উঠছে কঠোর।

আইএফআরসি জানিয়েছে, এর আগে ২০১০ সালের ডিজুড ছিল ভয়ংকর। ওই বারের ডিজুডের প্রভাবে  সব মিলিয়ে এক কোটি তিন লাখ প্রানী মারা গিয়েছিল। সংস্থাটির মতে, এ বছরের সংকটের প্রভাবে ২০১০ সালের ডিজুডের চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির পূর্বাভাস রয়েছে।

আইএফআরসির পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. ওলগা ঝুমায়েভা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, অনেক পশুপালক পরিবার তাদের মূল্যবান গবাদিপশু হারানো থেকে শুরু করে আর্থিক কষ্ট, সীমিত সম্পদ এবং সেইসঙ্গে মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। অনেক সংগ্রাম করছে মঙ্গোলিয়ার মানুষরা।

সারাবাংলা/আইই

ডিজুড মঙ্গোলিয়া