২ হাত ঘুরতেই সবজির দাম বেড়ে ৩ গুণ!
২৬ মার্চ ২০২৪ ২২:১৯
রংপুর: দেশের সবজিভাণ্ডারখ্যাত উত্তরের জেলা রংপুর। সেখানে এখন সবজির ভরা মৌসুম। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যাপ্ত। তা সত্ত্বেও সবজির নাগাল পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ক্রেতারা বলছেন, শীত শেষে বসন্তের শুরুর এই সময়ে শাক-সবজির দাম কমে যাওয়ার কথা। এর বদলে বরং এখনো সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এখানকার উৎপাদিত শীতকালীন সবজি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গেলেও খোদ রংপুরেই শাকসবজির দাম এতটাই চড়া যে নাভিঃশ্বাস উঠেছে ক্রেতা পর্যায়ে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবজি কিনতে ক্রেতাদের পকেট হালকা হয়ে গেলেও তার সুফল আবার পাচ্ছেন না কৃষকরা। বরং কৃষক পর্যায় থেকে হাতবদলের পর মধ্যস্বত্বভোগীরা বাড়িয়ে দিচ্ছেন সবজির দাম। প্রান্তিক বাজারে যে সবজি ৩০টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, জেলা শহরে পৌঁছাতেই তার দাম বেড়ে হয়ে যাচ্ছে দুই থেকে তিন গুণ!
সবজি উৎপাদনে যুক্ত কৃষকরাও বলছেন, জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে সার, বীজ, কীটনাশকসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। তাতে তাদের সবজি উৎপাদনে খরচও বেড়েছে। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত সবজি বিক্রি করে মুনাফা পাচ্ছেন খুব কমই। বলতে গেলে, কোনোমতে আবাদের খরচটা উঠে যাচ্ছে। অন্যদিকে সেই সবজিই মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে পড়তেই বেড়ে যাচ্ছে দাম। ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে অনেক বেশি টাকায়।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সবচেয়ে বড় সবজির হাট চতরা হাট। দেখা যায়, হাটে প্রচুর সবজির আমদানি। ক্রেতা-ব্যাপারীর হাঁকডাকে সরগরম হাট। সেখানে কৃষকরা সবজি বিক্রি করছেন অনেক সস্তা দামেই। উৎপাদন খরচ তোলার পর খুব একটা মুনাফা তাদের থাকছে না। অথচ হাটে হাতবদলের পর সেই সবজি খুচরা বাজারে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দামে।
চতরা হাটে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আলু কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩২ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, কালাই শিম ৫০ টাকা, বারি শিম ৪০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা, ফুলকপি ৩০ টাকা, কাঁচামরিচ ৫০ টাকা, পেঁয়াজ ৫০ টাকা, আদা ১৮০ টাকা ও টমেটো ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই হাটে একেকটি লাউ ৩০ টাকা, বাঁধাকপি ১০ টাকা, শাকের মধ্যে তিন আঁটি নাপা শাক ২৫ টাকা, লালশাক ২৫ টাকা, প্রতি আঁটি পালং শাক ১০ টাকা, সবুজ শাক ১০ টাকা ও লাউ শাক ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিকেল গড়াতেই চতরা বাজারে খুচরা পর্যায়ে গিয়ে কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ৯০ টাকা, গোল বেগুন ৭০ টাকা, লম্বা বেগুন ৬০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, ফুলকপি ৬০ টাকা, পেঁপে ৭০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৫০ টাকা, জালি কুমড়া প্রতিটি ৫০ টাকা, লাল পাকড়ি আলু প্রতি কেজি ৫০ টাকা, সাদা অ্যাসটরিক আলু প্রতি কেজি ৪০ টাকা ও পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।
চতরা হাটের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘১০ বছর ধরে শাক-সবজির ব্যবসা করছি। তবে এইবার শাকসবজির দাম অনেক বেশি। শীতেও সবজির চড়া দাম ছিল। ভাবছিলাম শীত কমে গেলে দাম কমবে। কিন্তু কমেনি। গত বছর এই সময় আলুর দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা ছিল। এ বছর ৩৬ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
বাড়তি দামের জন্য এই ব্যবসায়ী দায়ী করছেন কৃষকদের। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেশি। সে জন্য কৃষকরাও বেশি দামে বিক্রি করছেন।’
কৃষকরাও বাড়তি দামের কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। টোংরারদহ এলাকার চাষি সুরুজ মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার সবজি চাষে কৃষকরা মাঠে মারা। আবহাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদনে অনেক সমস্যা হয়েছে। সার, কীটনাশকের দাম অনেক বেশি। কীটনাশকও বেশি দিতে হয়েছে। ডিজেলের দাম বেড়ে গেলে সেচ খরচও বেড়েছে। বেড়েছে হালচাষসহ উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। তারপরও আমরা সবজিতে ভালো ফলন পেয়েছি।’
সুরুজ মিয়া আরও বলেন, ‘অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে ক্ষেত থেকে হাট পর্যন্ত পরিবহণ খরচ ছিল প্রতি মণ ২০০ টাকা, এখন তা ৩৫০ টাকায় ঠেকেছে। সবকিছু মিলিয়ে পীরগঞ্জে বিভিন্ন শাকসবজির উৎপাদন হলেও দাম একটু চড়া।’
সবজির ভালো ফলনের কথা জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডলও। তিনি বলেন, ‘গতবার এ সময়ে সবজির যেমন উৎপাদন ছিল, এ বছর তার চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে। মাঠে-বাজারে কোথাও সবজির ঘাটতি নেই।’ তবে দাম নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
কৃষক সুরুজ মিয়া ও ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান যেমন বললেন, সবজির ফলন ভালো হলেও উৎপাদন পর্যায়েই খরচ বেড়ে যাওয়ায় দামটা বাজারে বেশি। তারপরও কৃষক পর্যায়ে সবজির দাম যতটা বেড়েছে, তার চেয়েও বেশি বেড়েছে গিয়ে খুচরা পর্যায়ে, যেখানে দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। সাধারণ ক্রেতাদের তাই নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
হাটে বাজার করতে আসা কলেজ শিক্ষক হারুন চৌধুরী বলেন, ‘বাজারে প্রচুর শাকসবজি, উৎপাদনও ভালো। তবে দাম বেশি থাকার কারণে প্রয়োজনমতো সবজি কিনতে পারছি না। পত্রিকা-টেলিভিশনে দেখি রংপুরে সবজির ব্যাপক উৎপাদন। তাহলে রংপুরে সবজির দাম এত কেন? শীতকাল শেষ। এখনো আলু, লাউসহ সবকিছুর দাম বেশি। আর রোজার আগে আগে লেবু, শসা, বেগুনের দাম আকাশচুম্বী হওয়া তো নিয়মে পরিণত হয়েছে।’
এ তো গেল উপজেলা ও গ্রামপর্যায়ের হাট-বাজারের চিত্র। এবার দেখা যাক শহরের কী অবস্থা। রংপুর নগরীর সবচেয়ে বড় সবজির বাজার সিটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের সঙ্গে শহরের সবজির দামের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। দাম এতই বেশি যে ভোক্তাদের চোখেমুখে ক্ষোভ। আলু, শসা, লেবু, রসুন, কাঁচামরিচ বেগুন, শিম, লাউ— সবকিছুর দামই বেশ চড়া। বিশেষ করে রমজান ঘিরে যেন শসা, লেবু, বেগুনের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে।
সিটি বাজারে চিকন বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গোল ও মাঝারি বেগুনের কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ৭০-৮০ টাকা থেকে বেড়ে গোল বেগুন ১০০ এবং মাঝারি বেগুন ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ বাজারে প্রতি কেজি টমেটো ৪০ থেকে ৫০ টাকা, গাজর ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, পেঁপে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, শসা ৮০ থেকে ৯০ টাকা, সজনে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, মটরশুঁটি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৪০ থেকে ৫৫ টাকা, শিম ৬০ থেকে ৭০ টাকা, ফুলকপি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেল। এ ছাড়া প্রতি হালি লেবু ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, একেকটি লাউ আকারভেদে ৫০ থেকে ৬৫ টাকা, কাঁচকলা প্রতিহালি ৩৫-৪০ টাকা এবং সব ধরনের শাক প্রতি আঁটি ১৫ থেকে ২৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছিল।
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে সবজির দাম যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তা সরকারের এক তদন্তেও উঠে এসেছে। সম্প্রতি সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদন বলছে, কৃষকের উৎপাদিত সবজি খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পাঁচ থেকে ছয়টি হাতবদল হচ্ছে। আর এ কারণে ভোক্তাদেরও সবজি কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।
সরকারের এই সংস্থা বলছে, একদল মধ্যস্বত্বভোগীর ব্যবসায়িক আইডেন্টিটি (পরিচিতি), আড়ত বা পণ্য রাখার স্থান কিছুই নেই। কিন্তু তারা হাতবদলের একটি পর্যায় হিসেবে কাজ করছেন এবং পণ্যের মূল্য বাড়াতে ভূমিকা রাখছেন। এই দলটি রাতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে কাঁচা পণ্য যেমন— বেগুন, শসা ও লেবু খোলা রাস্তায় এবং কোনো আড়তের আংশিক জায়গায় বিক্রি করেন। তারা যেসব পণ্য বিক্রি করছেন সেগুলো কোথা থেকে কিনেছেন, তার কোনো রসিদ নেই। আবার আড়তদার বা পাইকারি বিক্রেতারা পণ্যের কোনো মূল্য তালিকাও প্রদর্শনের ধার ধারেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি বাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, ‘পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। রমজান এলেই বিভিন্ন প্রভাবশালীদের অপতৎপরতা শুরু হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে চলে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজি। না দিলে মারধর করে। খেসারত দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। এ টাকা তুলতে গিয়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। আর এ দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার সময় আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা হয়। এ জন্য চাঁদাবাজি বন্ধেও মনিটরিং সেলের নজর রাখা উচিত। তা না হলে আমাদের মতো বিক্রেতাদের ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা আছে।’
তবে ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি ফেরাতে শাকসবজিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে জানাচ্ছেন রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান। তিনি বলেন, ‘চলতি বছর রমজানে নিত্যপণ্যের দাম যেন না বাড়ে, এ জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে পাইকারি ও খুচরা বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বিশেষ মনিটরিং সেল নামানো হয়েছে।’
সারাবাংলা/এমও