মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়েছে, নিরীহদের আটক, দাবি জেনেভা ক্যাম্পবাসীর
২৬ মে ২০১৮ ১৬:১১ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ১৯:৫৯
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা : রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে শনিবার (২৬ মে) মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অভিযানে একশজনের বেশি মানুষ আটক হয়েছেন।
র্যাবের দাবি- মাদকবিরোধী অভিযান সফল হয়েছে এবং অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়েছে। অপরদিকে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দাবি, যারা প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ী তারা দুইদিন আগেই পালিয়েছে। অভিযান শুরু হওয়ার বিষয়টি তারা আগে থেকেই টের পেয়ে সটকে পড়েছে। র্যাব যাদের আটক করেছে তারা কর্মজীবী যুবক, তাদের অধিকাংশ নিরীহ। রাতের কাজ শেষে বাসায় ঘুমুনোর সময় র্যাব ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাদের গাড়িতে তুলে নেয় বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
শনিবার (২৬ মে) দুপুরে জেনেভা ক্যাম্পে সারাবাংলার কাছে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ এ সব কথা বলেন।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা সাবিনা ইয়াসমীন বলেন, ‘আমার চাচাত ভাই রিয়াজ ও মিরাজকে সাড়ে ১১টার দিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ধরে নিয়ে যায়। তারা দুজনই সেলুনে কাজ করে। সেহরি খেয়ে তারা নামাজ পড়ে সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের বাবা মা আগেই মারা গেছে। তারা দুইভাই মাদক ব্যবসায় যুক্ত না এটা পুরো জেনেভা ক্যাম্পে জিজ্ঞাসা করলে সবাই বলবে। আসল মাদক ব্যবসায়ীরা তো পালিয়ে গেছে। অভিযানের আগেই তারা পালিয়েছে।’
সখিনা বেগম জানান, তার বোনের ছেলে (ভাগ্নে) জনি ইসলামকেও তুলে নিয়ে যায়। জনি কাজ করে জরির দোকানে। জনি রাত জেগে কাজ করেন। ঈদ আসায় তার কাজের চাপ বেড়েছে। দিনে ঘুমায়। তাকেও ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় অভিযানে থাকা র্যাবের সদস্যরা।
এক প্রশ্নের জবাবে সখিনা বলেন, ‘কারা এখানে মাদক ব্যবসা করেন তা সবাই জানে। আমরা নাম বললে জবাই করে ফেলবে। যাদের ধরে নিয়ে গেছে তাদের কাউকেই দেখলাম না যে, এরা মাদক ব্যবসা করেন।’
আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমার দুই ছেলে টিপু ও শাকিলকে ধরে নিয়ে গেছে। তারা ঘুমিয়ে ছিল। এরা দুজন জরির দোকানে কাজ করে।’
জেনেভা ক্যাম্পে কসাইয়ের কাজ করেন বিকী সুলতান। তাকেও মাদক বিক্রির অভিযোগে নিয়ে যায়। অথচ বিকী সিগারেটও খান না বলে জানান তার দুলাভাই নরসুন্দর মোমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘র্যাব অনেক ব্যক্তিকে আটক করেছে। তাদের কারও হাতেই মাদক পাওয়া যায়নি।’
মুদি দোকানে বসে কাঁদছিলেন মোহাম্মদ ইসলাম নামে এক বৃদ্ধ। তার বাম পায়ের পাতা কাটা। পা ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় দোকান সামলাতে এসেছেন তিনি। কারণ তার একমাত্র ছেলে আকরামকে (৩০) র্যাব ধরে নিয়ে গেছে। র্যাবের অভিযানের সময় আকরাম দোকানেই ছিলেন বলে জানান তার বাবা মোহাম্মদ ইসলাম।
তিনি জানান, ৪০ বছর থেকে এ দোকান করছেন তিনি। তিনি ঠিকমতো চলতে পারেন না তাই এখন ছেলে দোকানে বসে। তার ছেলে মাদক বিক্রি তো দূরের কথা নিজেও কোনো মাদক সেবন করে না বলেন বাবা মোহাম্মদ ইসলাম।
শনিবার দুপুরে প্রায় তিন ঘণ্টার অভিযান শেষে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে মাদক সমস্যা একটি পুরনো সমস্যা। এখানে মাদকবিরোধী অভিযান সফলভাকে সম্পন্ন হয়েছে। অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়েছে। শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। যারা মাদকের সঙ্গে জড়িত নয় যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানান মুফতি মাহমুদ।
পরিচালক মুফতি মাহমুদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পে এতোদিন যারা মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের বলছি আপনারা মাদক ছেড়ে দেন। এখানে আর কাউকে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকতে দেওয়া হবে না। যারা সেবন করেন তারা এবং যারা বিক্রি করেন তারাসহ সরবরাহকারী সবাই মাদককে ছেড়ে দিতে বলছি। এখানে নিয়মিত অভিযান চলবে। ভাবার কোনো কারণ নেই যে, একদিন হয়েছে হয়ত আর অভিযান হবে না। এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখানে নিয়মিত অভিযান চলবে।’
অভিযানে কোন ধরনের মাদক এবং কী পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়েছে জানতে চাইলে মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘অভিযানে বিপুল সংখ্যক মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে কোন কোন মাদক রয়েছে তা পরবর্তীতে জানানো হবে।
তবে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কোনো মাদক দেখাতে পারেননি র্যাব।
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ৫০ হাজার লোকের বসবাস। ১৯৭১ সালের পর আটকে পড়া পাকিস্তানিরা সেখানেই বাস করে আসছেন। তাদের বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগ তারা মাদক বিক্রির সাথে সরাসরি জড়িত।
কী ধরনের মাদক বিক্রি হয় সেখানে জানতে চাইলে ওই ক্যাম্পের বাসিন্দা ইলেকট্রিক দোকানদার নজরুল ইসলাম বলেন, যতটুকু শুনেছি এখানে ইয়াবা বেশি বিক্রি হয়। গাঁজা বিক্রির অবস্থান দ্বিতীয়তে আর অন্যান্য মাদকও নাকি বিক্রি হয়। মানুষ বলাবলি করে তাই শুনি।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে র্যাব ও পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এ অভিযান চালানো হচ্ছে বলে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা জানিয়েছেন।
গত দুই সপ্তাহে মাদকবিরোধী অভিযানে অন্তত ৭০ জন মারা গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, এরা মাদক ব্যবসায়ী ও বিক্রেতা।র অভিযান চলাকালে বন্দুকযুদ্ধে তারা প্রাণ হারিয়েছেন।
চলমান মাদকবিরোধী অভিযান প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই অভিযানকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে মন্তব্য করেছেন।
সারাবাংলা/ইউজে/একে
আরও পড়ুন
জেনেভা ক্যাম্পে আর কাউকে মাদক ব্যবসা করতে দেওয়া হবে
জেনেভা ক্যাম্পে মাদকবিরোধী অভিযান, আটক শতাধিক
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook