Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘উন্নয়নের কোপের’ অপেক্ষায় ৪৬ গাছ, বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:০১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাছকাটার সিদ্ধান্তে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা ইতোমধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে সরব হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পর বিক্ষোভ গড়াচ্ছে মাঠেও। নাগরিকরা বলছেন, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে র‌্যাম্প নির্মাণের প্রয়োজন নেই।

চট্টগ্রাম নগরীর দ্বিতল সড়ক হিসেবে পরিচিত সিআরবিসংলগ্ন টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড অংশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৬টির মতো গাছ চিহ্নিত করেছে সিডিএ। এসব গাছ কাটার জন্য ইতোমধ্যে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি।

বিজ্ঞাপন

সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশের ওপরের অংশে টাইগারপাস থেকে কদমতলী মোড় এবং নিচের অংশে কদমতলী থেকে টাইগারপাসমুখী সড়ক ‘দ্বিতল সড়ক’ হিসেবে পরিচিত। বৃক্ষরাজি ঘেরা নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার এ স্থানটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। সড়কের বিভাজক হিসেবে রাখা পাহাড়ের ঢালে প্রতিরোধক হিসেবে আছে শত-শত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, যার মধ্যে বেশিরভাগই রেইনট্রি। এর মধ্যে শতবর্ষী বৃক্ষও আছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, র‌্যাম্প তৈরির কাজ পাওয়া সিডিএর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৪৬টি গাছকে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছে। টাইগারপাসের পুলিশ বক্সের সামনে থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত এলাকায় গাছগুলোর অবস্থান।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘র‍্যাম্প করতে হলে গাছগুলো কাটতে হবে। যেকোনো দিন গাছগুলো কাটা হবে। ওখানে কোনো শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৬টি গাছকাটার অনুমতি আমরা বন বিভাগ থেকে পেয়েছি। আর উন্নয়ন করতে গিয়ে যাতে পরিবেশ বা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে আমরা খেয়াল সবসময় রাখি। চেষ্টা করছি যত কম গাছ কাটা যায়।’

বিজ্ঞাপন

২০০৯ সালে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) সিআরবিকে হেরিটেজ এরিয়া বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত এলাকা ঘোষণা করেছিল সিডিএ। ড্যাপে সিআরবির কোনো অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না এবং সেখানে কোনো উঁচু স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না মর্মে গেজেট প্রকাশ করে সিডিএ। হেরিটেজ এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংস্থাটির।

সিডিএ’র সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিডিএ’র বিধিমালায় আছে, কোনো গাছের গোড়া অর্থাৎ মাটির নিচ থেকে ওঠা অংশের ব্যাস যদি এক ফুট বা তার চেয়ে বেশি হয়, সেই গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হবে না। কোনো ধরনের স্থাপনা করার জন্যও এ গাছ কাটা যাবে না। সিডিএ এখন নিজেরাই গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের বিধিমালা নিজেরাই লঙ্ঘন করছে।’

‘এই গাছ যদি অন্য কোনো সংস্থা কাটার উদ্যোগ নিত তাহলে সিডিএ অবশ্যই বাধা দিত। ২০১০ কি ১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অথবা সড়ক ও জনপথ বিভাগ একবার গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল। গাছগুলো মরে যাচ্ছে- এ অজুহাতে তারা কাটতে চাইলেও আমরা সিডিএর পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়েছিলাম। প্রকৃতির কী খেয়াল, তখন আবার গাছগুলোতে ডালপালা, পাতা গজাতে শুরু করে। তখন তারা আর সেগুলো কাটতে পারেনি,’- বলেন শাহীনুল ইসলাম খান।

জানতে চাইলে সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এখানে কোনো বিধিমালায় লঙ্ঘন হচ্ছে না। প্রয়োজন পড়ায় সেখানে র‍্যাম্প নামাতে হচ্ছে। আর হেরিটেজ এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের। আমরা কেন বিধিমালা লঙ্ঘন করব!’

যে এলাকায় গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের আওতাধীন। সিডিএ সেই ভূমি বরাদ্দের জন্য রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ২৫ মার্চ সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে আগ্রাবাদ ও টাইগারপাস এলাকায় দু’টি র‌্যাম্প নির্মাণে ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে বিমানবন্দরমুখী আপওয়ার্ড র‌্যাম্প নির্মাণে ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও রেলওয়ের পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক থেকে দেওয়ানহাটমুখী আপওয়ার্ড র‌্যাম্প নির্মাণে ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের কথা বলা হয়। তবে সে চিঠির জবাব এখনও দেয়নি রেলওয়ে।

জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিডিএ যেখানে র‌্যাম্প করতে চাচ্ছে, সেখানে অনেক গাছ আছে। ওরা আমাদের কাছে আবেদন করেছে জায়গা চেয়ে। আমরা তাদের জায়গা দিতে পারি। আর তারা সেখানে গাছ কাটতে পারবে কি পারবে না সেটা পরিবেশ অধিদফতর বা বন বিভাগ মতামত দেবে। যদি দু’টি সংস্থা অনুমতি দেয়, তবেই র‌্যাম্প নির্মাণের সুযোগ পাবে সিডিএ।’

এদিকে, বন বিভাগ থেকে গাছ কাটার অনুমতি সনদ পেয়েছে সিডিএ। সনদে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১টি রেইনট্রি কড়ই গাছ, চারটি ডিসি গাছ, দু’টি ইপিল, একটি কৃষ্ণচূড়া, তিনটি মেহগনি, একটি পেয়ারা গাছ কাটা হবে। এছাড়া ২৪টি অন্যান্য জ্বালানি গাছ কাটতে হবে।

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জয়নাল আবেদীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিডিএ তাদের একটি প্রকল্পের স্বার্থে কয়েকটি ছোট গাছ এবং গাছের ডাল কাটার জন্য আমাদের কাছে অনুমতি চেয়েছিল। ওখানে যেহেতু কোনো শতবর্ষী গাছ নেই, আর বড় গাছগুলোর শুধু ডাল কাটবে বলে উনারা উল্লেখ করেছেন, তাই আমরা তাদের অনুমতি দিয়েছি। প্রকল্পে শতবর্ষী দু’টি রেইনট্রি গাছের ডাল কাটতে হবে। বাকি গাছগুলো এখনো তেমন বড় হয়নি।’

গাছগাছালি, লতাপাতা ঘেরা সিআরবিসহ আশপাশের এলাকার উদ্ভিদ বৈচিত্র্য নিয়ে ২০২১ সালে গবেষণা করেছিল পরিবেশবাদী সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়নের (ইকো)। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩টি প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতির, গুল্ম ৪১ প্রজাতি, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি এবং লতা জাতীয় ২২টি প্রজাতি রয়েছে। শুধু সিআরবি এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া যায় ১৮৩ প্রজাতির। নয়টি বিপন্ন প্রজাতিও সেখানে রেকর্ড করা হয়।

প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিআরবি এলাকায় বড় বড় যেসব গাছ আছে, এর অধিকাংশের বয়স ১০০ বছর কিংবা তার ওপরে। এ ধরনের গাছ নিছক একটি গাছ শুধু নয়। একেকটি গাছের মধ্যে কমপক্ষে ১০০টি অন্যান্য ধরনের উদ্ভিদ যেমন- শৈবাল, মস, অর্কিড, পরগাছা থাকে।’

‘একটি উদ্ভিদকে জড়িয়ে আরও শত উদ্ভিদ থাকে, যেগুলো পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ধরনের অণুজীব, পাখি এখানে বাসা বাঁধে, পোকামাকড় বাসা বাঁধে। এগুলো জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টোটাল ইকোসিস্টেমকে ডেভেলপ করার জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব উদ্ভিদের নিচে অর্থাৎ মাটির নিচে অনেক ধরনের জৈবিক বিক্রিয়া হয়। অনেক ধরনের অনুজীব সেখানেও বসবাস করে। যার দরুণ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি হয় এবং মাটির গাঁথুনি ঠিক থাকে।’

গাছ কাটলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন র‌্যাম্প করার জন্য গাছ কাটবে বলছে, সেখানেও আমরা অনেক বিপন্ন এবং ঔষধি উদ্ভিদ পেয়েছিলাম। বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেললে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের যে সমতা সেটিতে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সবকিছুতেই প্রভাব পড়বে। গাছের যে কার্বন আত্মীকরণ প্রক্রিয়া, সেটা ব্যাহত হবে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

গাছ কেটে র‌্যাম্প নির্মাণ না করে বিকল্প উপায় খুঁজে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষক ওমর ফারুক রাসেল।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ে। সড়কটির যে অংশে র‌্যাম্প নির্মাণ হবে, সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আছে। এ কারণে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর কিংবা বন বিভাগের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিষয়টি বন বিভাগকে জানিয়েছি। যদি সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বিবেচনা করে সিডিএ ভিন্ন কোনো রুট চিন্তা করে, সেখানে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি।’

সিডিএর গাছ কাটার সিদ্ধান্তের খবরটি গত শনিবার (৩০ মার্চ) রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রোববার দিনভর সেটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা হয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

গাছ কাটার উদ্যোগের প্রতিবাদে প্রতিবাদে ‘শতবর্ষী গাছ রক্ষায় সুরক্ষা বৃত্ত’- এ স্লোগান নিয়ে সোমবার সকালে মানববন্ধন করেছে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। টাইগারপাস এলাকায় সেই গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো মানুষগুলোর হাতে থাকে পোস্টারে লেখা ছিল ‘গাছ কাটার আগে আমাকে কাটো, এসব মহীরুহ আমাদের প্রাণ, বেঁচে থাকা গাছ আপনার কি ক্ষতি করে?’

মানবন্ধনে বক্তব্য দেন- মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. সিকান্দার খান, গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমি, ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিটুল দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক স ম বখতেয়ার, গ্রিন ফিঙ্গারের আবু সুফিয়ান, কবি ফারহানা আনন্দময়ী, অগ্নিবীণা পাঠাগারের সৌরভ চৌধুরী এবং ক্ষুদিরাম পাঠাগারের রীপা মজুমদার।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, চট্টগ্রামের পরিচয় এই টাইগার পাসের আইকনিক রাস্তা। এই রাস্তায় দু’পাশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী গাছগুলো আমাদের ছায়া দিয়ে আসছে। চট্টগ্রামের ফুসফুস বলা হয় এই সিআরবিকে। আর উন্নয়নের নামে বারবার ধ্বংসের চক্রান্ত করা হচ্ছে সিআরবিকেই। আমরা শতবর্ষী গাছগুলো রক্ষায় সর্ব্বোচ আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই।

এ ছাড়া, বিকেলে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকদের উদ্যোগে একই স্থানে ‘সম্মিলিত নাগরিক সমাজ’র ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

কাঁটা গাছ ড্যাপ সিডিএ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর