রাজশাহীতে দুঃস্থদের চালে আ.লীগ নেতাকর্মীদের থাবা
৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৭
রাজশাহী: ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দুঃস্থদের জন্য রাজশাহীতে বরাদ্দ করা বিশেষ ভিজিএফ কার্ডে ভাগ বসাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলীয় লোকদের নামে কার্ডের তালিকা করে জমা দিয়েছেন। ফলে প্রকৃত দুঃস্থরা বিশেষ এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
রাজশাহীর ৭২টি ইউনিয়ন ও ১৪টি পৌরসভার জন্য ঈদ উপলক্ষে এক লাখ ২২ হাজার বিশেষ ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রতিটি কার্ডধারী দুঃস্থ ও অসহায় মানুষকে বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা। গত শনিবার থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে কার্ড ও চাল বিতরণ শুরু হয়েছে।
জেলার বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহীর কোনো কোনো ইউনিয়ন ও পৌরসভার জন্য বরাদ্দ করা কার্ডের অর্ধেক, আবার কোথাও চার ভাগের তিন ভাগই নিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এলাকার সংসদ সদস্য ও প্রশাসন থেকে চাপ দিয়ে দলীয় কোটা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক জনপ্রতিনিধি। দলীয় চাপে পৌরসভার মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড সদস্যরাও অসহায় হয়ে পড়েছেন। বঞ্চিত দুঃস্থদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ তারাও।
রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বিশেষ সহায়তা ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে পৃথক কমিটি রয়েছে। পদাধিকার বলে উপজেলা ত্রাণ কমিটির উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ত্রাণ কমিটির সভাপতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব। তবে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ভিজিএফ কার্ডের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব রয়েছে ওয়ার্ড সদস্য ও পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ওপর। কিন্তু তারা স্বাধীনভাবে কার্ডের তালিকা করতে পারছেন না। দলীয় নেতারা নিজেদের করা দুঃস্থ কার্ডের তালিকা করে ওয়ার্ড সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সই করতে বাধ্য করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, বাগমারা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় বিশেষ ভিজিএফ কার্ডের একটি বড় অংশই দলীয় নেতাকর্মীদের দখলে গেছে। এর মধ্যে গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের প্রতিটিতেই দুঃস্থদের চালে ভাগ বসিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
রাজশাহীর মুণ্ডুমালা পৌরসভার মেয়র সাইদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার পৌরসভায় এবার বিশেষ ভিজিএফ কার্ড এসেছে তিন হাজার ৮১টি। এর মধ্যে দলীয় নেতারা এক হাজার কার্ডের তালিকা আগেই দিয়ে রেখেছেন। সে অনুযায়ী আমরা চাল বিতরণ করেছি। বেশ কয়েক বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। সব বরাদ্দেই দলীয় কোটা থাকে। দুঃস্থদের চালের কার্ডেও আছে।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার জন্য ঈদ উপলক্ষে ছয় হাজার ৪০০ বিশেষ ভিজিএফ কার্ড এসেছে। এর মধ্যে এলাকার সংসদ সদস্যের মৌখিক নির্দেশে দুই হাজার ৩০০ কার্ড দলীয় লোকদের দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা দলীয়ভাবে কার্ডের তালিকা তৈরি করে পৌর মেয়রের কাছে জমা দিয়েছেন।
এই পৌরসভার একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, অর্ধেক কার্ড দলীয় কোটায় দেওয়ার পর বাকি দুই হাজার ৩০০ কার্ডের মধ্যে মেয়র নিয়েছেন ৪৫০টি। বাকি এক হাজার ৮৫০ কার্ড সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
গোদাগাড়ী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ৩৫০টি কার্ড বরাদ্দ হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে দেওয়া হয়েছে ১২৪টি। বাকি ১২৬টি কার্ডের দলীয় তালিকা জমা দিয়েছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের দলীয় নেতারা।’ এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘কার্ডগুলোতে কাউন্সিলরদেরই সই দিতে হচ্ছে। অথচ আমরা জানি না দলের তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা প্রকৃতই দুঃস্থ কি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভার জন্য ঈদ উপলক্ষে তিন হাজার ৮০টি বিশেষ ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ আসে। এর মধ্যে ৪৫০টি কার্ড দলীয় নেতাকর্মীদের দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আড়ানী পৌরসভার মেয়র মুক্তার হোসেন।
এদিকে রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ পৌরসভায় বিশেষ ভিজিএফ বরাদ্দ হয় চার হাজার ৬০০টি। এই পৌরসভার মেয়র আব্দুল মালেকের দাবি, দলীয় কোটায় তিনি কোনো কার্ড দেননি। আব্দুল মালেক বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্যের হয়ে কিছু দলীয় নেতা কিছু কার্ড দাবি করেছিলেন। কিন্তু আমি নিজেই পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমি দলীয় কোটায় কোনো কার্ড দেইনি। ওয়ার্ড কাউন্সিলররাই প্রকৃত দুঃস্থদের তালিকা করে চাল বিতরণ করেছেন।’
‘দলীয় কোটা’ তৈরি করে দুঃস্থদের চালে ভাগ বসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন আল ওয়াদুদ বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে বিশেষ দুঃস্থ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি কার্ডের বিপরীতে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিধি-বিধান অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিরা প্রকৃত দুঃস্থদের তালিকা করে চাল বিতরণ করবেন— এমন নির্দেশ দেওয়া আছে। দলীয় কোনো কোটার কথা সরকারি নির্দেশনানামায় নেই।’
জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ত্রাণ-পুনর্বাসন কমিটির সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, ‘এসব বিশেষ বরাদ্দ প্রকৃত দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য। দলীয় কোনো কোটার সংস্থান নেই। কেউ এমনটা করলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/টিআর