যেভাবে ঘটেছিল সদরঘাট দুর্ঘটনা
১২ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:০২
মধ্য রোজা থেকেই ঈদ সামনে রেখে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ির পথে ছুটতে শুরু করে মানুষ। মূল চাপটা পড়ে ঈদের ঠিক আগের কয়েকটা দিন। বাস, ট্রেন, লঞ্চ সবখানেই থাকে তীব্র ভিড়। অনেকে ঈদের আগে ছুটিও পান না। ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত থাকেন অন্য কাজে। ঈদুল ফিতরে বাড়ি যাওয়ার জন্য তাই অনেকেই বেছে নেন ঈদের দিনটিকেই।
আরও পড়ুন- স্বামী-সন্তান নিয়ে ঈদে বাড়ি ফেরা হলো না অন্তঃসত্ত্বা মুক্তার
এমনই কিছু মানুষ বাড়ির পথে রওনা দিতে গিয়েছিলেন সদরঘোটে। লঞ্চ টার্মিনাল থেকে চড়বেন নিজ নিজ গন্তব্যের লঞ্চে। কিন্তু ঈদে আর বাড়ি যাওয়া হলো না তাদের। লঞ্চে ওঠার অপেক্ষা যখন করছিলেন, আচমকা আরেক লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে সেই দড়ির তীব্র আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তারা।
ঈদুল ফিতরের দিন বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সদরঘাটের মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান পাঁচজন। তাদের একজন ফেরিওয়ালা, বাকি চারজন যাত্রী হতে এসেছিলেন সদরঘাটে। এর মধ্যে তিনজন একই পরিবারের— স্বামী-স্ত্রী ও তাদের তিন বছর বয়সী এক সন্তান। স্ত্রী আবার ছিলে অন্তঃসত্ত্বা।
নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ১১ নম্বর পন্টুনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল তাসরিফ-৪ ও টিপু-১৩ নামের দুটি লঞ্চ। রাত ৮টা/ সাড়ে ৮টার দিকে তাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। অন্য পাশে ছিল পূ্বালী-১ লঞ্চটি, যার ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল কিছুক্ষণ পরেই। ওই লঞ্চে তখন যাত্রীরা উঠছিলেন। কয়েকজন যাত্রী লঞ্চে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহতরাও ছিলেন একই লাইনে।
নৌ পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এরকম সময় এমভি ফারহান-৬ লঞ্চটি সদরঘাটে ভিড়ছিল। সেটি নোঙর করার সময় ধাক্কা দেয় টিপু-১৩ লঞ্চে। সেই ধাক্কার জের ধরেই তীব্র ঝাঁকুনি খায় তাসরিফ-৪ লঞ্চটি। এতে লঞ্চটি যে দড়ি দিয়ে পন্টুনে বেঁধে রাখা ছিল, সেটি ছিঁড়ে যায়। সেই দড়ি তীব্র বেগে আঘাত করে পূবালী-১ লঞ্চে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের।
নৌ পুলিশ ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) গৌতম কুমার রায় সারাবাংলাকে বলেন, এমভি তাসরিফ-৪ ও এমভি টিপু-১৩ লঞ্চ দুটি পাশাপাশি নোঙর করে রাখা ছিল। আরেক লঞ্চ এমভি ফারহান-৬ সেখানেই নোঙর করার চেষ্টা করলে সজোরে ধাক্কা দেয় টিপু-১৩ লঞ্চে। এর জের ধরেই টিপু-১৩ ধাক্কা দেয় তাসরিফ-৪ লঞ্চকে। এতে তাসরিফের দড়িটি ছিঁড়ে যায়। ওই দড়িটিই সজোরে আঘাত করে পন্টুনের আশপাশে থাকা পাঁচজনকে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন— মো. বেল্লাল (২৫), মুক্তা (২৫), মাইশা (৩), মো. রিপন হাওলাদার (৩৮) ও মো. রবিউল (১৯)। এর মধ্যে বেল্লাল ও মুক্তা দম্পতির মেয়ে মাইশা। মুক্তা সাড়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাদের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। বাকি দুজনের মধ্যে পাঠাও চালক মো. রিপন হাওলাদারের (৩৮) বাড়ি পটুয়াখালী সদর। আর ফেরি করে পাউরুটি বিক্রেতা মো. রবিউলের (১৯) বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদরে।
তাসরিফ-৪ লঞ্চটি যেখানে নোঙর করা ছিল, তার বিপরীত দিকের একটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় (সিসি ক্যামেরা) ধরা পড়েছে দুর্ঘটনার সময়কার দৃশ্য। আধা মিনিটের ওই ফুটেজ সারাবাংলার হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের মতোই কর্মচাঞ্চল্য ছিল সদরঘাটের ১১ নম্বর পন্টুনে। এমভি পূবালী-১ লঞ্চের সামনে ছিলেন বেশ কয়েকজন। হঠাৎ তাসরিফ-৪ লঞ্চের দড়িটি ছিঁড়ে গেলে তা সজোরে আঘাত করে কয়েকজনকে। মুহূর্তের মধ্যে তারা পন্টুনে লুটিয়ে পড়েন।
পরে নৌ পুলিশের অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুতই সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, দুর্ঘটনার সময়ই মূলত তাদের সবার মৃত্যু হয়েছে। মিটফোর্ড হাসপাতালের ডোম মোহাম্মদ মিলন শেখ জানান, পাঁচজনেরই মৃত্যু হয়েছে মাথায় আঘাত লেগে।
এদিকে সদরঘাটের দুর্ঘটনার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এমভি তাসরিফ-৪ ও এমভি ফারহান-৬ লঞ্চের পাঁচজনকে আটক করে নৌ পুলিশ। পরে ঢাকা নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ এই পাঁচজনকে আসামি করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা করেছে।
কেরানীগঞ্জ থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) শহীদুল জানান, মামলার আসামিরা হলেন— এমভি তাসরিফ-৪ লঞ্চের প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. মিজানুর রহমান (৪৮) ও দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার মো. মনিরুজ্জামান (২৪) এবং এমভি ফারহান-৬ লঞ্চের প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. আব্দুর রউফ হাওলাদার (৫৪), দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার মো. সেলিম হাওলাদার (৫৪) ও ম্যানেজার মো. ফারুক খাঁন (৭৬)।
এদিকে দুর্ঘটনায় জড়িত দুই লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। নৌ পুলিশ ঢাকা অঞ্চলের এসপি গৌতম কুমার রায় বলেন, সদরঘাট দুর্ঘটনায় জড়িত এমভি ফারহান-৬ ও এমভি তাসরিফ-৪-এর রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে।
এ দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থাটির পরিচালক (ক্রয় ও সংরক্ষণ) রফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. আজগর আলী ও বন্দর শাখার যুগ্ম পরিচালক মো. কবীর হোসেনকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন-
লঞ্চের দড়ির আঘাতে প্রাণ গেল ৫ জনের
স্বাভাবিক সদরঘাট, চালু হয়েছে যাত্রী চলাচল
সদরঘাটে হতাহতের ঘটনায় শাস্তি পাবেন দোষীরাঃনৌ প্রতিমন্ত্রী
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর