কুয়াশার বিয়ের টাকা-গহনা, রাধারাণীর কপাল— পুড়ল সবই আগুনে
১৫ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৩৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মেয়ে কুয়াশার বিয়ের বাকি আর মাত্র এক মাস। তার জন্য অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেছিলেন মা রাধারাণী দাস। সেই সঞ্চয়ের দেড় লাখ টাকা তুলে এনে রেখেছিলেন বিয়ের খরচের জন্য। রেখেছিলেন দুভরি গহনাও। অন্য সব প্রস্তুতিও চলছিল ধীরে ধীরে। আচমকা সব শেষ। দেড় ঘণ্টার এক আগুন কেড়ে নিয়েছে রাধারাণীর সব সঞ্চয়, মেয়ের বিয়ের গহনা।
অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় পাবেন মেয়ের বিয়ের টাকা? কোথায় পাবেন সোনার গহনা? আগুন শুধু মেয়ে কুয়াশার বিয়ের টাকা-গহনা পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কেড়ে নিয়েছে রাধারাণী ও তার পরিবারের মাথার ওপরের ছাদও। সেমিপাকা ঘরের কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই। সব হারিয়ে এখন তাদের ঠাঁই নিতে হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। রাধারাণী সেখানেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
রাধারাণীর বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার মেরিনার্স রোডসংলগ্ন এয়াকুব নগর টেকপাড়া এলাকায় বস্তিতে। সোমবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে সেই বস্তিতে আগুন লাগে। দুপুর ১টা ২০ মিনিটে খবর পেয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের চারটি স্টেশনের ৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। কিন্তু এর মধ্যেই বস্তির ৬০ থেকে ৭০টি বসতঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রেহাই পায়নি সেসব ঘরের কেউই।
বিকেলে টেকপাড়া বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনের পোড়া ছাইয়ের মধ্যেই ঘরের জিনিসপত্র খুঁজছে রাধারাণীর পরিবার। কারও হাতে পোড়া হাড়ি-পাতিল, কারও হাতে বাসন, কেউ খুঁজছেন অন্যন্য আসবাবপত্র। ছাইয়ের স্তূপে সেলাই মেশিন, খাট, বই ও কাপড়সহ অনেক কিছুই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের পরিবার। আগুনের সূত্রপাতও তাদের ঘরেই। সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বস্তির অন্যান্য ঘরে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, নারকেল গাছের সঙ্গে বৈদ্যুতিক খুঁটির তার লাগানো ছিল। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের ফুলকি গিয়ে রাধারাণীদের ঘরের টিনের চালে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সেই ফুলকি থেকে আগুন ধরে যায়।
রাধারাণীদের যৌথ পরিবার। স্বামী হরিকমল দাস একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। চার ভাইয়ের মধ্যে হরিকমল সবার বড়। মেজো ভাই পরিকমল দাস মারা গেছেন দুই বছর আগে। সেজো ভাই কিরণ দাসও চাকরি করেন পোশাক কারখানায়। সবার ছোট সুজন দাস করেন ব্যবসা। চার ভাইয়ের যৌথ পরিবারের সাজানো সংসার নিমিষেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
রাধারাণী কান্নায় ভেঙে পড়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ঘরে ছিলাম। ছোট ছেলে এসে জানায়, আমাদের ঘরের টিনে আগুন ধরেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে নিয়ে বাইরে চলে আসি। মুহূর্তের মধ্যে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। এক ঘণ্টার মধ্যেই আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে যায়। আমার সব শেষ।’
‘বড় মেয়ের একমাস পর বিয়ে। সেজন্য দেড় লাখ টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। দুই ভরি সোনার গহনাও ছিল। মেজো মেয়ের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। কিছুদিন আগে ওর জন্য নতুন বই কেনা হয়েছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একটি সুতাও বের করতে পারিনি,’— বলেই বিলাপ শুরু করেন রাধারাণী।
হরিকমল দাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘অফিস থেকে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিলাম। হঠাৎ দেখি রান্নাঘরের পাশে ধোঁয়া। দুপুরের রান্না হয়েছে, কিন্তু ভাত খাওয়া হয়নি। এরই মধ্যে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বড় মেয়েটার বিয়ের জন্য দুই ভরি গহনা কিনেছিলাম। সেগুলোও বের করতে পারিনি।’
রাধারাণীর তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে কুয়াশা দাস, মেজো মেয়ে অঙ্কিতা দাস, ছোট মেয়ে অদ্রি দাস। ছেলের নাম নীরব দাস। সবাই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।
অঙ্কিতা দাস এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী। জুনেই পরীক্ষা। তাই কদিন আগেই বাবা কিছু বই এনে দিয়েছিলেন। অঙ্কিতা প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন পুরোদমে। আগুন পুড়িয়ে দিয়েছে তার সব বই-ও। নতুন-পুরনো সব বই হারিয়ে এখন কীভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন, তা বুঝতে পারছেন না। এই তরুণী।
অঙ্কিতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩০ জুন পরীক্ষা শুরু। পরশু বাবা নতুন বই কিনে এনেছিলেন। নতুন বই তো বটেই, আগের সব বইও পুড়ে গেছে। এখন বই ছাড়া পড়বই বা কী, আর পরীক্ষাই বা দেবো কীভাবে! তাছাড়া আমাদের পুরো ঘর আগুনে পুড়ে গেছে। মাথার ওপর এখন খোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই নেই। এক কাপড়ে আমরা কোনোমতে বেরিয়ে এসেছি।’
রাধারাণীর একমাত্র ছেলে নীরব সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুপুরে বাইরে বসেছিলাম। তখনো ভাত খাইনি। হঠাৎ দেখি বৈদ্যুতিক তারে আগুন। সেখান থেকে ফুলকি এসে পড়ল আমাদের টিনের চালে। মুহূর্তেই পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। আমি তাড়াতাড়ি করে ডেকে কোনোমতে সবাইকে বাইরে ডেকে আনতে পেরেছি।’
আগুনের খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্থানীয় ফিরিঙ্গিবাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগুনে ৬০ থেকে ৭০টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন যেন আগুন বেশি ছড়িয়ে না যায়। আগুন বেশি ছড়াতে না পারলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি।’
বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি প্রাথমিকভাবে প্রতিটি পরিবারকে তিন হাজার টাকা ও লুঙ্গি-শাড়ি দিয়ে সহায়তার ঘোষণা দেন।
এ সময় মেয়র বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধার কার্যক্রম তরান্বিত করতে সমন্বয় করছি। আমাদের তিনজন কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিষ্কার করতে কাজ করছেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে তিন হাজার টাকার নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া হবে। পুরুষদের লুঙ্গি ও নারীদের শাড়ি দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সোমবার রাত এবং মঙ্গলবার দুপুর ও রাতের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর পুননির্মাণে টিন দেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/আইসি/টিআর