বাইরে রোদের জ্বালা, ঘরে ক্ষুধার জ্বালা
২১ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৩৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: গনগনে রোদ। আকাশের দিকে তাকালে যেন চোখই ঝলসে যায়। সূর্যটা যেন আগুনের থালা। বাতাসেও আগুনের হলকা। তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে। জারি হয়েছে হিট অ্যালার্ট। রোদের মধ্যে বাইরে বের হলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি প্রবল— বলছেন চিকিৎসকরা। হিট স্ট্রোকে একাধিক মৃত্যুর খবরও মিলেছে বিভিন্ন জেলা থেকে।
তবু কি ঘরে আটকে থাকার সুযোগ আছে সবার? সূর্যের চোখ রাঙানি কি আর সবার দৈনন্দিন জীবনের গতি থামাতে পারে? শৈতপ্রবাহ হোক আর তাপপ্রবাহ— শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের তো কোনো নিস্তার নেই। জীবনের চাকা তো ঘুরতেই থাকে তাদের। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ তো তাদের জন্য নয়। তাই গনগনে রোদকে সঙ্গী করেই পেটের দায়ে রাস্তায় নামে মানুষ, রিকশা-ভ্যান টেনে নিতে হয়, যাপিত জীবনের বোঝা মজদুরের কাঁধে লবণ কিংবা সারের বোঝা হয়ে চেপে বসে।
তাই হয়তো কষ্টের সাতকাহন বলতে গিয়ে মজদুর আবু তাহেরের মেজাজ চরমে ওঠে। ‘বাইরে গরমের জ্বালা, ঘরে ক্ষুধার জ্বালা— আমি কোথায় যাব!’ কর্ণফুলী নদীর ঘাটে-ঘাটে বোঝা বয়ে চলা আবু তাহেরের খেদোক্তি এমনই!
আরও পড়ুন- তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ, অব্যাহত থাকতে পারে ৫ দিন
নগরীর সার্সন রোডে রিকশা রেখে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছিলেন চালক আবুল কাশেম। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে চট্টগ্রাম শহরে রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি টেনে নিয়ে যান আবুল কাশেমরা। সবুজ হারিয়ে গেছে, পাহাড়ি পথগুলো এখন আবুল কাশেমদের দিচ্ছে শুধুই তপ্ত রোদের জ্বালা।
রংপুর থেকে জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রাম শহরে থিতু হওয়া আবুল কাশেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘরে স্ত্রী আছে, চার ছেলে-মেয়ে। এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। শাশুড়ি থাকেন সঙ্গে। রিকশা না চালালে পেটে ভাত জুটবে? গ্যারেজ ভাড়া আড়াই শ টাকা, ডেইলি বাজার খরচ আড়াই শ টাকা। আগে পাঁচ শ টাকা জোগাড় করে তারপর অন্য কথা! উঁচু রাস্তায় গাড়ি চালানো অনেক কষ্টের, একটা টান দেয়ার পর আধা ঘণ্টা জিরাইতে হয়, চা-নাস্তা খাইতে হয়।’
বাস্তবতার কাছে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে আবুল কাশেম শেষে বলেন, ‘আমরা তো কাকা আপনাদের মতো সাহেব না। রাস্তায় না নামলে আমাদের পেটে খাওন জোটে না।’
কর্ণফুলী নদীর ঘাটে ভেড়া জাহাজ থেকে লবণ, সার, গমসহ বিভিন্ন পণ্য বস্তায় ভরে সেই বস্তা পিঠে চড়িয়ে গুদামে নিয়ে যান যেসব শ্রমিক, তাদের অবস্থা আরও করুণ। কাঠফাটা রোদে ঘামে ভেজা শরীর, পিঠ যেন পুড়ে কয়লা! নগরীর মাঝিরঘাট, বাংলাবাজারসহ আশপাশের এলাকায় এভাবেই তাপপ্রবাহের মধ্যেও বোঝা বয়ে চলেছেন শত শত শ্রমিক।
ঘাটশ্রমিক সাইদুলের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। স্ত্রী, দুই সন্তান, মা আর ছোট বোন নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম শহরের ছোটপুলে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে।
সাইদুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবার আছে, সংসার আছে, বাসা ভাড়া আছে, খাওন-দাওন আছে। কষ্ট হলেও কী করব, আমার একলার ওপর চলে সংসার। আমাদের উপায় নাই। এখন ৪২ ডিগ্রি গরম পড়ছে, ৫২ ডিগ্রি পড়লেও আমাদের বের হইতে হবে। আমাদের কাজ করতে হবে।’
‘ভোরে বের হইছি। এখন বাজে ২টা। সকাল থেকে চার-পাঁচ শ টাকা কামাইছি, অনেক কষ্ট করে কামাইছি। এখন বাসায় যাব, খাওয়া-দাওয়া করব, রাতে আবার বের হব,’— বলেন সাইদুল।
ঘাটশ্রমিক পটুয়াখালীর শাহীন লবণের বস্তা টেনে চলেছেন। রোদের তাপ আর লবণের উত্তাপ— সব মিলে জেরবার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাজ করতে পারলে টাকা আছে, করতে না পারলে টাকা নাই। কোনোদিন ৪০০ টাকা কামাই, কোনোদিন এক হাজার টাকাও কামাই। আজ কাজ হবে, কালকে কাজ নাই। গরম ঠিক আছে, কিন্তু পেট চালাতে হলে তো গরমেও কাজ করতে হবে।’
তিন দিন আগে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ নিয়েও ঘাট থেকে গুদামে বস্তা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মুনির। কথা বলার ফুরসত নেই তার।
শ্রমিক ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেস্ট করুম কীভাবে? রেস্ট করলে আমাদের খাওয়াবে কে? বাসা ভাড়া কে দেবে? পেটে খাওন কে দেবে? গরম বেশি, কী করব, একটা উপায় বলেন দেখি!’
কুমিল্লায় বাড়ি আবু জাহেদের। তাপপ্রবাহের মধ্যেও বোঝা টেনে ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার ক্ষোভ জানিয়ে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই যে আমরা বস্তা ভরি, বস্তা টানি, একটা বস্তায় পাই কত? ৩০-৪০ টাকার মতো। এক কেজি আলুর দাম কত? এত গরম, কয়টা বস্তা আর টানতে পারি? বৌ আছে, ছেলেমেয়ে আছে। মা মারা গেছে। আমার ঘরবাড়ি নাই। দেশের বাড়ি নাই। থাকলে চলে যেতাম। খেতখামারের কাজ করতাম।’
ঘাটশ্রমিক আবু তাহের সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ যদি কাজ না করি, গরমের জন্য বসে থাকি, ঘরে তো রান্না হবে না। রাস্তায় বের হলে গরমের জ্বালা, রোদের তাপ, ঘরে ক্ষুধার জ্বালা। গরম যতই পড়ুক, কাজ করতে হবে। আমি কাজ না করলে কন্ট্রাক্টর কি মানবে? কাল তো আর কাজ দেবে না। তাহলে খাব কীভাবে? আমি ছাড়া কেউ আয়-উপার্জন করার মতো নেই।’
সিআরবিতে ছোট্ট ঝুপড়ি চায়ের দোকানে সিঙ্গারা ভাজছিলেন সেকায়াত। কড়াইয়ে উত্তপ্ত তেল, চুলায় আগুনের উত্তাপ, মাথার ওপর রোদের তাপ। সেকায়েতের শরীর কি মেনে নিয়েছে ত্রিমুখী তাপ?
জানতে চাইলে সেকায়েত সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটাই আমাদের কাজ। সিঙ্গারা বানানো ছাড়া আর কোনো কাজ তো শিখি নাই। যারা ঘর থেকে বের না হওয়ার কথা বলছে, তাদের বলেন আমার ঘরে চাল, ডিম, আলু দিয়ে আসতে।’
রোববার (২১ এপ্রিল) চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে এক দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। গত তিন দিনে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাতও হয়নি।
চট্টগ্রামের প্রধান আবহাওয়া কার্যালয়ের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. আব্দুল বারেক সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের আবহাওয়া সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ৮ থেকে ১২ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যা অস্থায়ী ঝড়ো বা দমকা হাওয়ার আকারে ২৫ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হতে পারে।
বৈশাখ শুরুর দিন কয়েক আগ থেকেই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। এর ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত শনিবার (২০ এপ্রিল) থেকে তিন দিনের জন্য হিট অ্যালার্ট জারি করে আবহাওয়া অধিদফতর।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশের ৪৯ জেলাতেই এখন তাপপ্রবাহ বইছে। রোববার (২১ এপ্রিল) আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পাবনা, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী জেলাসহ খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এ ছাড়া, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফেনী, কক্সবাজার, চাঁদপুর ও রাঙ্গামাটিসহ বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
যশোরে শনিবার মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেটা অবশ্য রোববার ৪০ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
উত্তরাঞ্চলের রংপুরে রোববার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সামনের দিনগুলোতে এখানকার তাপমাত্রা আরও ১ থেকে ২ ডিগ্রি বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর