পরিবহণ ধর্মঘটে বিচ্ছিন্নপ্রায় চট্টগ্রাম, তীব্র ভোগান্তি
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১২:২৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম মহানগরী ও পাঁচ জেলায় শুরু হওয়া ৪৮ ঘণ্টার পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে তীব্র ভোগান্তি তৈরি হয়েছে। নগরী থেকে জেলা-উপজেলায় গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ আছে। একইভাবে জেলা-উপজেলা থেকে কোনো গণপরিবহণও নগরীতে ঢুকতে পারছে না। দূরপাল্লার গণপরিবহণেরও একই পরিস্থিতি। এর ফলে কার্যত চট্টগ্রাম অঞ্চল সড়ক পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়ির অভাবে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে কর্মস্থল ও গন্তব্যে যাওয়ার জন্য শত শত মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। অনেকে গণপরিবহণ না পেয়ে ট্রাকে করে গন্তব্যে ছুটছেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ খোলার প্রথম দিনে দুর্ভোগে পড়েন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। নগরীতে রিকশা, অটোরিকশা চলাচল করলেও বেশি ভাড়া দাবি করছিলেন চালকরা।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীদের গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানোর প্রতিবাদসহ চার দাবিতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ এ কর্মসূচি দিয়েছে। রোববার (২৮ এপ্রিল) ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘট মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) ভোর ৬টা পর্যন্ত চলবে বলে ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে। ধর্মঘটের আওতায় আছে সব ধরনের বাস-মিনিবাস, অটোরিকশা, অটোটেম্পু ও হিউম্যান হলার।
রোববার ভোর থেকে নগরীর বিভিন্ন রুটে কিছু বাস, মিনিবাস চলতে দেখা গেছে। অটোরিকশা চলাচল প্রায় স্বাভাবিক আছে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস মালিকদের আটটি সংগঠন আছে। এর মধ্যে সাতটি ধর্মঘটের সঙ্গে একাত্মতা জানালেও একটি সংগঠন জানায়নি। সে সংগঠনের বাসগুলো রাস্তায় চলছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন বাস মালিক সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাসগুলো রাস্তায় চলছে। যে ধর্মঘট চলছে, সেটাতে আমরা নেই।’
এর মধ্যে সকালে ধর্মঘট আহ্বানকারী সংগঠনের শ্রমিকরা নগরীতে বাস-মিনিবাস চলাচল ঠেকাতে রাস্তায় নামেন। নগরীর বহদ্দারহাটসহ কিছু এলাকায় বাস ভাঙচুরের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর থেকে বাস-মিনিবাস চলাচল সীমিত হয়ে এসেছে। তবে অটোরিকশা চলাচলে বাধা দিচ্ছে না পরিবহণ শ্রমিকরা।
নগরীর চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘বহদ্দারহাট মোড়ে ধর্মঘটের মধ্যে গাড়ি চলাচল করা নিয়ে কয়েকজন পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছে। গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। হাতাহাতি করতে গিয়ে হয়তো সামনের একটি বা দুটি কাঁচ ভেঙে যেতে পারে। ঘটনার পরপরই পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।’
শাহ আমানত সেতু এলাকায় নগরীর প্রবেশমুখে দেখা যায়, বিভিন্ন উপজেলা এবং বান্দরবান-কক্সবাজারমুখী শত শত যাত্রী সেখানে ভিড় করেছেন। গাড়ি না থাকায় তারা কোথাও যেতে পারছেন না। অনেককে পরিবার নিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে দেখা গেছে। গরমে হাঁসফাঁস করছে শিশুরা। কক্সবাজার রুটে দুয়েকটি গাড়ি ছাড়লেও ৪২০ টাকার ভাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ অটোরিকশায়, কেউ ট্রাকে উঠে ছুটছেন গন্তব্যের পথে।
সুরাইয়া বেগম শনিবার সাতকানিয়া উপজেলা থেকে নগরীতে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন। রাতে আত্মীয়ের বাসা ছিলেন। স্বামীসহ আবার বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু সেতু এলাকায় এসে দেখেন, গাড়ি চলছে না।
বিপাকে পড়া সুরাইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাতকানিয়া যাব। দুই ঘণ্টা হয়েছে এখানে এসেছি। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। কীভাবে যাব, জানি না। কাউন্টারে গিয়েছিলাম। গাড়ি চলবে না বলছে। গরমে খুবই খারাপ অবস্থা।’
রুবেল নামে এক যাত্রী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কক্সবাজার যাব। ৪২০ টাকার ভাড়া ৭০০ টাকা। সব কাউন্টার বন্ধ।’
সৈকত মিয়া নামে আরেক যাত্রী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আধাঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। চট্টগ্রাম মেডিকেলে এক রোগীকে রক্ত দিতে যাচ্ছি। কিন্তু কোনোভাবেই যেতে পারছি না। এটা তো ভালো হচ্ছে না। মামলা-হামলা হলে দেশে আইন আছে। এরা তো আইনের বাইরে কাজ করছে। এদের ডাবল শাস্তি দেওয়া উচিত। হাজার হাজার মানুষ লাইন ধরে আছে। কেউ শহরে সুখে আসেনি। সবাই বিভিন্ন কাজে এসেছে।’
নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) তারেক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ আছে। অলঙ্কার, একে খান মোড়, সিটি গেট, কদমতলী থেকে দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়ছে না। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে। শহরে বাস চলছে। কোথাও তেমন কোনো গণ্ডগোলের খবর আমরা পাইনি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
ঐক্য পরিষদে যুক্ত সংগঠন পূর্বাঞ্চলীয় সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মৃণাল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট চলছে। দূরপাল্লার বাস কোথাও চলছে না। চট্টগ্রাম শহরে যে বাসগুলো চলছে সেগুলো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন বাস মালিক সমিতির। তারা ধর্মঘটের সঙ্গে নেই। তাদের ১৫০-২০০টি বাস আছে। সেগুলো হয়তো নগরে চলছে।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুপুর আড়াইটায় ধর্মঘট আহ্বানকারী পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে ডেকেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। সার্কিট হাউজে এ বৈঠক হবে।
মৃণাল চৌধুরী বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক হবে। তবে মনে হয় না তারা আমাদের সব দাবি এত তাড়াতাড়ি পূরণ করতে পারবে। চুয়েটের ঘটনায় আমরা ছাত্রদের সব দাবি মেনে নিয়েছি। তবুও তারা আমাদের তিনটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে, চার-পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। ওই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে শ্রমিকরা ভয় পাচ্ছে। এসব কিছুর সমাধান না হলে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।’
ধর্মঘট আহ্বানকারী সংগঠনের দাবির মধ্যে আছে— চুয়েটে দুই শিক্ষার্থী নিহতের জেরে চার-পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর ও তিনটি বাস জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় মামলা গ্রহণ, ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার। চুয়েটের তিন শিক্ষার্থীকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি নিবন্ধিত ছিল কি না, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল কি না, তিনজন একইসঙ্গে মোটরসাইকেলে ওঠার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন হয়েছে কি না ও তারা মাদকাসক্ত ছিল কি না— এসব বিষয় তদন্তে কমিটি গঠনের দাবিও রয়েছে তাদের। চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে ওয়েবিল চেকার-লাইনম্যানসহ পরিবহণ শ্রমিকদের গণগ্রেফতার বন্ধের দাবিও জানিয়েছে তারা।
প্রসঙ্গত, ২২ এপ্রিল বিকেলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের জিয়ানগর এলাকায় চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে শাহ আমানত পরিবহণের একটি বাস মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। মোটরসাইকেলে আরোহী ছিলেন চুয়েটের তিন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই শান্ত সাহা (২০) ও তৌফিক হোসেন (২১) নামে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। শান্ত চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ২০ ব্যাচের ও তৌফিক ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী। একই ঘটনায় আরেক শিক্ষার্থী জাকারিয়া হিমু গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন। দুর্ঘটনার দুদিন পর ২৪ এপ্রিল ঘাতক বাসের চালককে পুলিশ গ্রেফতার করে।
ঘটনার পর ২২ এপ্রিল বিকেল থেকে ২৫ এপ্রিল রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে আসছিলেন। আন্দোলনের মধ্যে ২৫ এপ্রিল বিকেলে চুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে চুয়েটের পরীক্ষাসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সব একাডেমিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এতে ছাত্রদের বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার মধ্যে এবং ছাত্রীদের শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ঘোষণার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ক্যাম্পাসের স্বাধীনতা চত্বর ও মূল ফটকে রাখা শাহ আমানত পরিবহণের দুটি বাসে তারা আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া বিকেলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। এ সময় উপাচার্য, সহউপাচার্য ও রেজিস্ট্রার প্রায় দুঘণ্টা ওই ভবনে অবরুদ্ধ হয়ে থাকেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ২০ জনের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠকে বসে প্রশাসন। বৈঠকে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ও হলত্যাগের নির্দেশনা পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেয় চুয়েট প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের হলে থাকারও অনুমতি দেওয়া হয়।
এরপর রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে করে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়ে অবরোধ তুলে নিলে চার দিন পর চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি ক্যাবের
এদিকে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), চট্টগ্রাম।
রোববার সকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্যাব নেতারা বলেন, ‘গণপরিবহণ, শ্রমিক ও মালিকরা দেশের আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বারবার দেশের জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করার কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে গণপরিবহণের লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করবে। আর তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চাইলেই মানুষকে জিম্মি করে ঘর্মঘট ডাকবে, এটা নিছক বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়। তারা যদি আইনের শাসনে বিশ্বাসী হয়, তাহলে আইনিভাবেই তাদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে তার প্রতিকার চাইতে পারত।’
বিবৃতিতে ক্যাবের নেতারা নিরাপদ গণপরিবহণের দাবিতে চুয়েট শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান। নেতারা আরও বলেন, ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহণ মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ বা অন্য যারা এই ব্যবসায় যুক্ত, সবাই সরকারি দলের নেতা বা কর্মী। আর তারাই বিভিন্ন সময়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দাবি আদায়ের জন্য জনগণকে বারবার জিম্মি করেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার দলীয় নেতাকর্মী হিসেবে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ন হয়, এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত।’
ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু, সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, যুগ্ন সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, মো. সেলিম জাহাঙ্গীর ও দক্ষিণ জেলার সভাপতি আবদুল মান্নান যুক্তভাবে এ বিবৃতি পাঠিয়েছেন।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/ইআ