পোলট্রিতে তাপপ্রবাহের হানা, খামারিদের চোখে অন্ধকার
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২২:২৪
ঢাকা: সারাদেশে চলমান তাপপ্রবাহে খামারে খামারে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে মুরগি। পাশাপাশি কমতে শুরু করেছে ডিমের উৎপাদন। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে প্রান্তিক খামারিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
খামারিদের দাবি, কেবল সর্বশেষ ১৫ দিনেই ২০০ কোটি টাকার বেশি মুরগি মারা গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী জুন-জুলাই মাসে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে। লেয়ার বা সোনালি মুরগির সরবরাহও একইভাবে পড়বে সংকটে। আর এই সংকট আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণের পাশাপাশি ভর্তুকি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন খামারিরা।
খামারিরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ খামারের ঘরের চাল টিনের। আর রোদের তাপ টিনে বেশি লাগে। এ কারণে মুরগির গরমও লাগে বেশি। পর্যাপ্ত পরিমাণ ফ্যান চালিয়ে ব্রয়লার মুরগির শেডে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। তাপমাত্রা বেশি হয়ে গেলে পাম্পের মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় তাপ। কিন্তু চলমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতে এর কিছুই কাজে আসছে না।
তারা আরও বলছেন, চলমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতির সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে লোডশেডিংয়ের ধাক্কা। এতে সময়মতো ফ্যান বা পাম্প চালানোও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকায় খরতাপে ছটফট করছে মুরগি। মারা পড়ছে একের পর এক। বিশেষ করে বৈশাখের শুরু থেকে পোলট্রি মুরগির শেডগুলোতে বেহাল দশা শুরু হয়েছে।
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার খামারি জাহিদুল ইসলামের ব্রয়লার মুরগির খামার ২৫টি। প্রতিটি খামারেই প্রতিদিন কয়েকটি করে মুরগি মারা যাচ্ছে। জাহিদুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অতিরিক্ত গরমের কারণে হিট স্ট্রোক করে আমাদের মুরগি মারা যাচ্ছে। আমাদের অনেক টাকা লোকসান হচ্ছে। অতিরিক্ত খাবার ব্যয় হচ্ছে। দিনে চার থেকে পাঁচ বার পানি দিয়েও মুরগি বাঁচানো যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা পথে বসব।’
একই অবস্থার কথা জানালেন রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের আশরাফের মোড়ের খামারি নজরুল ইসলামও। প্রতিটিতে চার হাজার হিসাবে তার পাঁচটি খামারে প্রায় ২০ হাজার মুরগি আছে। গত এক মাসে এসব খামারে ৫০টি মুরগি মারা গেছে শুধু গরমের কারণে।
নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অতিরিক্ত গরমে মুরগিগুলো মারা যাচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহ কমে গেলে মুরগি মারা যাওয়ার হার কমে যাবে।’
পবার রনহাটের সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এখানে প্রায় ১২০০ মুরগি আছে। গত এক মাসে ৩০টির মতো মুরগি মারা গেছে। এসব মুরগিকে বেশি শীতল রাখা যায় না, আবার বেশি গরমও রাখার সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে মুরগিগুলো মারা যাচ্ছে।’
দিঘির পারিলা গ্রামের গবাদি পশুর ওষুধ বিক্রেতা সোহেল রানা বলেন, ‘তীব্র এই গরমে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে মুরগি। গরমের কারণে তারা স্ট্রোক করছে। খামারি বা স্থানীয়ভাবে যারা মুরগি পালন করছেন, তারা এসে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাপমাত্রা না কমলে ওষুধ দিয়ে মুরগি বাঁচানো কঠিন। একই অবস্থা গরু-ছাগলেও। তবে এখন পর্যন্ত কোনো গরু-ছাগল এলাকায় মারা যায়নি।’
দেশের অন্যান্য এলাকার খামারিদের কাছ থেকেও মুরগি মরে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাপপ্রবাহ বন্ধ না হলে মুরগির মৃত্যু ঠেকানো যাবে না জেনে তারা অসহায় বোধ করছেন।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলমান তাপপ্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোকে সারা দেশে বিভিন্ন খামারে গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মুরগী মারা যাচ্ছে। আমাদের হিসাব বলছে, গড়ে প্রতিদিন এক লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে। সর্বশেষ ১০ দিনে সারা দেশে যে পরিমাণ মুরগি মারা গেছে, এর আনুমানিক বাজারমূল্য হবে প্রায় দুই শ কোটি টাকা।’
এ পরিস্থিতিতে ডিম ও মুরগি উৎপাদন ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে বলে জানাচ্ছেন পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতা। তার ধারণা, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী জুনের দিকে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে, যা আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
পোলট্রি মুরগির শেডগুলোতে তাপমাত্রার প্রভাবও ব্যাখ্যা করলেন সুমন হাওলাদার। তিনি জানাচ্ছেন, সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তামপাত্রা মুরগীর জন্য সহনীয় ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি হলেই বিপদ শুরু হয়। আর তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি হলে মুরগি বাঁচানো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে।
সুমন বলেন, ‘গত ১০ থেকে ১২ দিনে সারা দেশে অনেক ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল ব্রয়লার মুরগি, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লেয়ার মুরগি। বাকি ৫ থেকে ১০ শতাংশ সোনালিসহ অন্যান্য মুরগি। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২০০ কোটি টাকা। এ অবস্থা আর কয়েকদিন চলতে থাকলে খামারগুলো বন্ধই হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) মহাসচিব খন্দকার মো. মহসিনও একই কথা জানিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে খামারের অনেক মুরগি মারা যাচ্ছে। ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে খামারিরা লোকসানের কবলে পড়েছেন। কারণ প্রচণ্ড গরমে ডিম সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। ফলে খামারিদের বাধ্য হয়ে কম দামে ডিম ও মুরগি বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে তারা লোকসানের কবলে পড়েছেন। এ লোকসান কাটিয়ে ওঠা কঠিন।’
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হকও খামারিদের চলমান এই সংকটসময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে নিলেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলমান তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশের খামারিরা কিছুটা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা অবগত আছি এবং করণীয় হিসেবে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত মন্ত্রণালয়ের লোকজন সারা দেশের খামারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন।’
তবে মন্ত্রণালয়ের নজরদারি আর পরামর্শেই সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না খামারিরা। এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলেই ভর্তুকি প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি ফিডে ভর্তুকি দিয়ে খামারিদের উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ব্যাংক ঋণ সুবিধার পাশাপাশি ভারত থেকে মুরগির বাচ্চা আমদানির সুযোগ দেওয়া। তা না হলে খামারিরা টিকে থাকতে পারবেন না।’
একই দাবি জানিয়ে অ্যসোসিয়েশনের মহাসচিব খন্দকার মহসিন বলেন, ‘খামারিদের রক্ষা করতে হলে সরকারিভাবে প্রযুক্তিগত সহায়তার পাশাপাশি ডিম সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়াও খামারিদের ভর্তুকি এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিতে হবে। তা না হলে আগামী জুন-জুলাই মাসে দেশে ডিম ও মুরগির সংকট চরম আকার ধারণ করবে।’
গরমে ডিম নষ্ট হচ্ছে, মুরগি মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় খামারিরাও ভর্তুকিসহ ডিম সংরক্ষণাগার স্থাপনের দাবি তুলেছেন। সরকার এ বিষয়ে কিছু ভাবছে কি না— জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডিজি ডা. রেয়াজুল বলেন, ‘ডিম সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হলে ডিম মজুত করে দাম বাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এতে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে আমাদের ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে খামারিদেরে বিষয়ে সরকর নজর রাখছে। প্রয়োজন অনুযায়ী সব কিছু করা হবে।’
পোলট্রি খামারিদের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
চলমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতে পোলট্রি খামারিদের জন্য পরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) পরিচালক এবং ফিজিওলজি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফার্মের মুরগিগুলো ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এর বেশি হলে সেগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে মারা যায়। তাই খামারে পর্যাপ্ত সিলিং ফ্যান লাগাতে হবে, স্ট্যান্ড ফ্যান রাখতে হবে। কোল্ড স্প্রে করতে হবে। খামারে বাতাস আসা-যাওয়ার সুব্যবস্থা রাখতে হবে। বেডিংগুলো পাতলা করতে হবে। স্যালাইন, লেবুর রস খাওয়াতে হবে। কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না।’
সিভাসুর প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুরগির শরীরে পালক আছে, যা জ্যাকেটের মতো কাজ করে। এ কারণে মুরগির শরীরে হিটটা রয়ে যায়। ফলে তার হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিটা মারাত্মক। মুরগি মারা যাচ্ছে, তাদের বাঁচানো জরুরি। সাধারণত খামারিরা ওষুধ খাইয়ে মুরগি বাঁচাতে চান। এটা সম্ভব নয়। খামারের তাপ কমানো ছাড়া বিকল্প কোনো পন্থা নেই। টিনের চালে নিয়মিত পানি ছিটালেও অনেক উপকার হবে।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সারাবাংলার রাজশাহী ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট মাহী ইলাহি ও দিনাজপুর ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট সোহেল রানা]
সারাবাংলা/জিএস/আরডি/টিআর
ডিম উৎপাদন তাপপ্রবাহ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন পোলট্রি খামার ব্রয়লার মুরগি মুরগি উৎপাদন মুরগির খামার