যশোর বোর্ড: সেই ২ কোটি টাকার তদন্তে অপারগ অধ্যক্ষ, অভিযোগ দুদকেও
৩ মে ২০২৪ ০৯:০০
যশোর: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাড়ে সাত কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলমান অবস্থায় বোর্ডের আর্থিক দুর্নীতির আরেক অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। প্রশ্ন ব্যাংকের দুই কোটি টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ থেকে এ অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় কেবল দুদক নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ জমা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি তদন্তে কমিটিও গঠন করা হয়েছে। যশোররের সরকারি এম এম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মর্জিনা আক্তারকে প্রধান করা হয়েছিল তদন্ত কমিটিতে। তবে তিনি বোর্ড চেয়ারম্যানের জুনিয়র কর্মকর্তা, এমন অজুহাতে নিজেকে তদন্ত কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তদন্ত অধস্তন কাউকে করা সমীচীন নয় বলে তার দাবি।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর সারাবাংলা ডটনেটে ‘প্রশ্ন ব্যাংকের ২ কোটি টাকা ভাগাভাগি, বাদ পড়েনি কেউ’ শিরোনামে এ নিয়ে খবর প্রচার হলে টনক নড়ে সব মহলে। পরে যশোরের স্থানীয়সহ জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম এ বিষয়ে খবর প্রচারিত হয়।
বোর্ড, দুদক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ মার্চ ২ কোটি টাকার ভাগভাগিতে বঞ্চিত কয়েকজন তদন্ত ও প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা অডিট অধিদফতর, দুদক মহাপরিচালক ও যশোর দুদক কার্যালয় বরাবর।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা কমিটি গত ২৮ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে সময় নির্ধারণ করে চিঠি দেয়। উপসচিব মো. শাহীনুর ইসলামের সই করা চিঠিতে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বোর্ড বাজেটের প্রশ্ন ব্যাংক খাতের দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগসংক্রান্ত বিষয়ে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুস্পষ্ট মতামত দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- প্রশ্নব্যাংকের ২ কোটি টাকা ভাগভাগি, বাদ পড়েনি কেউ!
ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একই শিরোনামে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) মো. তানভীর হাসান যশোর সরকারি এম এম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মর্জিনা আক্তারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত কর্মদিবস সময় দিয়ে ১৭ এপ্রিলে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে যশোর বোর্ড চেয়ারম্যান ড. আহসান হাবিব ছাড়াও বোর্ড সচিব অধ্যাপক মো. আব্দুর রহিম, উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, প্রোগ্রামার মো. জাকির হোসেন, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন, বোর্ড সিবিএ সভাপতি মো. আব্দুল মান্নান ও মো. রাকিব হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে বলা হয়।
অভিযোগকারীদের আবেদনে উল্লেখ ছিল, এই কয়েকজনের যোগসাজশে সাত বছরের এরিয়া বিল ভাগবাঁটোয়ারা করা হয়। এতে একজন ঝাড়ুদারও দেড় লাখ টাকা পেয়েছেন ভাগে। এতে বিধি যেমন ভঙ্গ করা হয়েছে, তেমনি অবসরে যাওয়া ও বদলি হয়ে যাওয়া মোট ৪৮ জনের টাকাও ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগভাগি করে নিয়েছেন। এ কাজ করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা ওঠানো হয় বলে অভিযোগকারীদের দাবি। এ ঘটনায় জড়িত সাতজন সেই টাকার ১০ লাখ টাকা রিজার্ভে রেখেছেন অডিট ঠেকানোর নামে। অবশিষ্ট ১০ লাখ টাকা বিল পাস করার পুরস্কার হিসেবে চেয়ারম্যানকে তিন লাখ টাকা, সচিব ও উপপরিচালকের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে এবং সিবিএ সভাপতি ও সম্পাদকের প্রত্যেকে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।
অভিযোগপত্রে এমন আরও গুরুতর অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যক্ষ অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার চলতি সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট দফতরে ঘটনাটি তদন্তে অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, বোর্ড চেয়ারম্যানের পদ আমার পদের চেয়ে সিনিয়র। ফলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আমি তদন্ত করতে পারি না। এটি বিধি বহির্ভূত হবে।
এদিকে অধ্যাপক মর্জিনা বিধির কথা বললেও বোর্ডের একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার ও বোর্ড সচিব অধ্যাপক মো. আব্দুর রহিম দুজনই বোর্ড চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে নানা তদবিরে ব্যস্ত রয়েছেন। অধ্যাপক মর্জিনা তাই বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে নাখোশ করতে রাজি নন।
এদিকে একই অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকেও। দুদক অবশ্য সেই অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে। যশোর দুদকের উপপরিচালক মো. আল আমিন বলেন, অভিযোগ ও পেপার কাটিংসহ দরখাস্ত পেয়েছি। তদন্ত চলছে। তদন্তের স্বার্থে সব কথা বলা যাবে না। দুদক নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তদন্ত করছে।
এর আগে সারাবাংলা ডটনেটে ‘প্রশ্ন ব্যাংকের ২ কোটি টাকা ভাগাভাগি, বাদ পড়েনি কেউ’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, প্রশ্ন ফাঁস রোধ ও প্রশ্নের গুণগত মান সংরক্ষণে ২০১৬ সালে প্রশ্ন ব্যাংক চালু করে যশোর বোর্ড। এ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন শ্রেণির বার্ষিক, অর্ধবার্ষিক বা এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনি ও প্রাক নির্বাচনি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রশ্ন ব্যাংক তৈরির সময় সিদ্ধান্ত ছিল, প্রতি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী প্রতি এক সেট প্রশ্নের জন্য ১০ টাকা হারে ফি বোর্ডকে দেবে প্রতিষ্ঠান। বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা ওই টাকার ২০ শতাংশ ভাগ করে নেবেন। বাকি ৮০ শতাংশ বোর্ডের তহবিলে জমা হবে।
শুরু থেকে এ হিসাবে টাকা তোলা হলেও গত বছর এর ব্যতিক্রম হয়। ২০ শতাংশের বদলে ৬০ শতাংশ টাকাই তুলে নেওয়া হয়। আগে যে কয় বছরের টাকার ২০ শতাংশ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রেও আরও ৪০ শতাংশ করে টাকা তোলা হয়। এরিয়ার আকারে ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রশ্ন ব্যাংকের আয়ের বর্ধিত ৪০ শতাংশ (নিয়মিত ২০ শতাংশের বাইরে) প্রায় দুই কোটি টাকা তোলা হয় গত নভেম্বরে। চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই সেই টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন। এতে ওই সময় কর্মরতরা ক্ষুব্ধ হন। তাদের বঞ্চিত করে বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
এদিকে এই আর্থিক দুর্নীতির আগে বোর্ডের ৩৮টি চেকে সাড়ে সাত কোটি টাকা লোপাটের খবর সারাদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই ঘটনাতেও দুদকে মামলা হয়। মামলাটির চূড়ান্ত অভিযোগপত্র আদালতে জমা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
এর মধ্যে আরেকটি আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ দুদকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে জমা হওয়া ও তদন্ত কমিটি গঠন যশোর বোর্ডের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে বলে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিমত। তারা বলছেন, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তি দিয়ে বোর্ডকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া দরকার।
সারাবাংলা/টিআর
এরিয়ার বিল তদন্ত কমিটি দুদক প্রশ্ন ব্যাংক যশোর বোর্ড যশোর শিক্ষা বোর্ড শিক্ষা মন্ত্রণালয়