ইরানকে নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় যেভাবে সহায়তা করছে চীন
৪ মে ২০২৪ ১০:৩৯
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে তিন শতাধিক মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালায়। ওই সময়ই নতুন করে ইরানের তেল রফতানিতে কঠোর বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। ওদিকে ইরানের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিই তেল। বলা যায়, দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে আছে তেলের ওপর। তাহলে নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে ইরান কীভাবে নিজেদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে? তারা কি নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে পারছে?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের বিপক্ষে নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে তাদের তেল রফতানির পরিমাণ ছিল গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায়। ইরানের কাস্টমপ্রধানের হিসাব বলছে, এর পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন তথা তিন হাজার ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার!
বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইরানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের বাণিজ্য কৌশলের ওপর নির্ভর করেই মূলত ইরানের তেল রফতানি তথা অর্থনীতি টিকে রয়েছে। ইউএস হাউজ ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের তথ্য বলছে, চীনে প্রতিদিন ১৫ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি করে ইরান। সার্বিকভাবে তাদের তেল রফতানির ৮০ শতাংশই যায় চীনে।
ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে নানাবিধ ঝুঁকি ও জটিলতা থাকলেও চীন কেন ইরান থেকে তেল কেনা বন্ধ রাখে না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো— ইরানের তেল মানে ভালো, দামেও সস্তা। যুদ্ধোন্মুখ বিশ্বে বিভিন্ন দেশ যখন সত্যি সত্যিই যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন বিশ্বব্যাপীই তেলের দাম বাড়ছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল রফতানির সুযোগ কম। ফলে তারা কম দামে তেল বিক্রি করে থাকে। এই সুযোগটিই নেয় চীন।
ট্রেডার্স আর শিপট্র্যাকার্সের তথ্য নিয়ে রয়টার্স ২০২৩ সালের অক্টোবরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়, ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে ইরান, রাশিয়া ও ভেনিজুয়েলা থেকে তেল কেনার মাধ্যমে চীন অন্তত এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় করেছে। এই দেশগুলোই মূলত কম দামে তেল বিক্রি করে থাকে।
অপরিশোধিত তেলের যে বৈশ্বিক মানদণ্ড, তা পরিবর্তিত হয়। তবে সাধারণত প্রতি ব্যারেলের দাম ৯০ ডলারের নিচে থাকে। ডেটা ও অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপিএলআরের সিনিয়র অ্যানালিস্ট হুমায়ুন ফালাকশাহীর হিসাব বলছে, ইরান তাদের ক্রুড তথা অপরিশোধিত এই তেল ব্যারেলপ্রতি ৫ ডলার কমে বিক্রি করছে।
পুরো বিষয়টির ভূরাজনৈতিক দিকও আছে বলে মনে করেন ফালাকশাহী। তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের যে ‘খেলা’ চলছে, ইরানের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও তারই একটি অংশ। ইরানের অর্থনীতিকে সহায়তার মাধ্যমে, চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে একটা ভূরাজনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে যখন ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা চলমান।
চায়ের পাত্রে পরিশোধন!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেহরানের নিষিদ্ধ তেল আমদানি-রফতানির জন্য ইরান ও চীন কয়েক বছর ধরে একটি সূক্ষ্ণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। আটলান্টিক কাউন্সিলে ইকোনমিক স্টেটক্র্যাফটের সহকারী পরিচালক মাইয়া নিকোলাদজ বিবিসিকে বলেন, এই বাণিজ্য কৌশলের প্রধান উপকরণ হলো চীনা চায়ের পাত্র (ছোট স্বতন্ত্র পরিশোধনাগার), ‘ডার্ক ফ্লিট’ ট্যাংকার্স এবং চীনের আঞ্চলিক ব্যাংক, যাদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি খুব কম।
নিকোলাদজ যেসব ‘টি-পট’ তথা চায়ের পাত্রের কথা বলছেন, সেগুলোও মূলত তেল পরিশোধনাগার। এগুলো আকারে খুবই ছোট। আংশিকভাবে স্বনিয়ন্ত্রিত বা বেসরকারিভাবে পরিচালিত। এগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশাল সব পরিশোধনাগারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলোতেই ইরানের তেল পরিশোধন করা হয়।
ফালাকশাহী বলেন, এগুলো মূলতই তেল পরিশোধনাগার। আকারে ছোট আর দেখতে চায়ের কাপের মতো বলেই একে ‘টি-পট’ বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব বেইজিংয়ের শানডং অঞ্চলে এগুলো বেশি দেখা যায়।
এই ছোট পরিশোধনাগারে চীনের জন্য কম ঝুঁকি থাকে। কারণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে। সেগুলোতে মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রবেশাধিকারও থাকে। ফালাকশাহী বলেন, ছোট বেসরকারি পরিশোধনাগারগুলো দেশের বাইরে চালিত হয় না, ডলারেও লেনদেন করে না এবং বিদেশি তহবিলেরও প্রয়োজন পড়ে না।
ডার্ক ফ্লিট
তেলের ট্যাংকারগুলো বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে ট্র্যাক করা হয়। বিভিন্ন সফটওয়্যার তাদের অবস্থান, গতি ও রুট পর্যবেক্ষণ করে। নিকোলাদজ বলেন, এই ট্র্যাকিং এড়ানোর জন্য ইরান ও চীন একটি অস্পষ্ট মালিকানা ধরনের ট্যাংকার্স নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যেটি সঠিক অবস্থান দেখায় না। তারা খুব সহজেই পশ্চিমা ট্যাংকার্স ও নানা শিপিং সার্ভিস সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পারে। ফলে তাদের পশ্চিমা নীতি ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয় না।
এসব ‘ডার্ক ফ্লিট’ তেল বহনের সময় সাধারণত তাদের অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) বন্ধ করে রাখে, যেন তাদের শনাক্ত করা না যায় অথবা এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গার অবস্থান দেখিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এসব জলযান আন্তর্জাতিক জলসীমায় গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সফার জোনের বাইরে গিয়ে চীনের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য পার করে এবং কখনো কখনো এ জন্য তারা বেছে নেয় খারাপ আবহাওয়ার সময়কে। ফলে এই তেলটি প্রকৃতপক্ষে কোথা থেকে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন হয়ে যায়।
ফালাকশাহী বলেন, এই তেলের হাতবদলটা বেশি হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জলসীমায়। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের পূর্ব দিকে একটি অঞ্চল আছে, সেখানে একটি জায়গায় ঐতিহাসিকভাবেই অনেক ট্যাংকার চলাচল করে এবং নিজেদের মধ্যে কার্গো পরিবহন করে।
এরপর আসে এই তেলকে নতুন করে ব্র্যান্ডিংয়ের বিষয়টি। এই পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে ফালাকশাহী বলেন, দ্বিতীয় আরেকটি জাহাজ মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমা থেকে আসে চীনের উত্তর-পূর্বে এবং তেলটা তারা পৌঁছে দেয়। এর মাধ্যমে মনে হয় যে এই ক্রুড অয়েল ইরান থেকে আসেনি। বরং মনে হয় মালয়েশিয়া থেকে এসেছে।
ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) পরিসখ্যান অনুযায়ী, চীন ২০২৩ সালে ২০২২ সালের তুলনায় ৫৪ শতাংশ বেশি তেল মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করেছে। তবে অবশ্যই মালয়েশিয়া চীনে তেল রফতানির যে হিসাব দিয়েছে তা দেশটির মোট তেল উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যায়। বিশ্লেষক নিকোলাদজ তাই মনে করেন, এ কারণেই এটা ধারণা করা হয় যে মালয়েশিয়া আসলে ইরানিয়ান তেল রফতানির তথ্য দিচ্ছে।
গত বছরের জুলাই ও অক্টোবরে রিপোর্ট আসে যে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ ইরানিয়ান ট্যাংকার আটক করেছে ‘অনুমতিবিহীন তেল পরিবহণে’র জন্য।
ক্ষুদ্র ব্যাংক
আন্তর্জাতিক লেনদেনের পদ্ধতি যা পশ্চিমারা পর্যবেক্ষণ করে, তার বদলে চীন ও ইরানের লেনদেন হয় ক্ষুদ্র চাইনিজ ব্যাংকের মাধ্যমে।
মাইয়া নিকোলাদজ বলেন, চীন নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরানের তেল কেনার ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। ফলে তারা বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংককে এই লেনদেনে যুক্ত করতে চায় না। এর বদলে তারা সেসব ব্যাংক ব্যবহার করে যাদের কোনো আন্তর্জাতিক পরিচিতি নেই।
ইরানকে এই তেলের জন্য চীনা মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করা হয় বলেও মনে করা হয়, যেন ডলার নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটানো যায়।
ফালাকশাহী বলেন, এই অর্থ চীনা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়, যাদের সঙ্গে ইরান কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক রয়েছে। এরপর সেই অর্থ চীনা পণ্য আমাদানিতে কাজে লাগানো হয় এবং অবশ্যই বাকি অর্থ ইরানে ফেরত যায়। কিন্তু এটা বোঝা খুবই কঠিন যে কীভাবে এটা হয়ে থাকে এবং ইরান কি আসলেই তাদের সব অর্থ ফেরত নিতে পারে দেশে।
কিছু কিছু রিপোর্টে বলা হয়, ইরান তাদের দেশের অভ্যন্তরে ‘মানি এক্সচেঞ্জ’ ব্যবহার করে এই অর্থটা কোথা থেকে আসছে সেই নিশানা মুছে ফেলার জন্য।
দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা
গত ২৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনের জন্য এক সহায়তা প্যাকেজে সই করেন, যার মধ্যে ইরানের তেল ক্ষেত্রের ওপর নতুন আরও নিষেধাজ্ঞাও ছিল। নতুন নীতি এমন সব বিদেশি বিভিন্ন বন্দর, যান ও পরিশোধনাগারের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়ে দিয়েছে, যারা চলমান নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরানের ক্রুড অয়েল পরিবহণ বা প্রক্রিয়াজাত করেছে। একইসঙ্গে তথাকথিত দ্বিতীয় আরেকটি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে চীনের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিষিদ্ধ ইরানি ব্যাংকগুলোর মধ্যে পেট্রোলিয়াম ও তেল সম্পর্কিত পণ্য কেনার ক্ষেত্রে সব লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে।
তবে ফালাকশাহী মনে করেন, ওয়াশিংটন তাদের সব ধরনের উপায় কাজে লাগানোর ব্যাপারে ঠিক পুরোপুরি আগ্রহী নয়। তিনি বলেন, এর কারণ বাইডেন প্রশাসনের প্রধান লক্ষ্য যাতে কোনোভাবেই তাদের দেশে জ্বালানির মূল্য বেড়ে না যায়। তাদের পররাষ্ট্রনীতির চেয়েও এই বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পেট্রোলিয়াম রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন অপেকে ইরান তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ, যারা প্রতিদিন ৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপন্ন করে যা সারা পৃথিবীর তেলের ৩ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উৎপাদন ও পরিবহন ব্যাহত হলে আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে।
ফালাকশাহী বলেন, বাইডেন জানেন যে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল রফতানি আরও কমিয়ে আনতে বাধ্য করে, তাহলে বাজারেও সরবরাহ কমে যাবে এবং বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বেড়ে যাবে। আর যদি সেটা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেও জ্বালানির দাম বাড়বে। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি বাইডেন অবশ্যই এড়াতে চাইবেন।
সারাবাংলা/টিআর
ইরান চীন তেল আমদানি তেল উৎপাদন তেল পরিশোধনাগার তেল রফতানি বাণিজ্য সম্পর্ক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা