‘বিকট শব্দ শুনে আকাশে তাকাই, দেখি বিমানে আগুন জ্বলছে’
৯ মে ২০২৪ ২২:৫০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকাই। দেখি, আকাশে একটি বিমানের পেছনে আগুন জ্বলছে। মুহূর্তেই দু’পাশ থেকে দু’জন প্যারাশুট নিয়ে ঝাঁপ দেন নদীতে। আর বিমানটি বিধ্বস্ত হয় নদীতে থাকা একটি সবুজ রংয়ের বয়ার পাশে।’
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়া নিয়ে এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঘটনাস্থলে থাকা ‘এমটি জুবিলি দোয়া’ নামে একটি জাহাজের প্রকৌশলী মিজানুর রহমান। ওই জাহাজের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিমান থেকে প্যারাশুটে নেমে আসা দুই পাইলট পানিতে পড়েন। নদীর দুই পাড় থেকে দুইটা ইঞ্জিনবোট যাত্রী নিয়ে পার হচ্ছিল। তারা দ্রুত এগিয়ে যায়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে ইঞ্জিন বোট দু’টিতে থাকা মাঝি ও যাত্রীরা দুই পাইলটকে উদ্ধার করে।’
মাতব্বর ঘাটের ইজারা সংগ্রাহক মো. রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানে আগুন দেখে মানুষ চিৎকার করছিল। প্যারাসুট দিয়ে নেমে পড়েন দুই পাইলট। আমরা যারা ঘাটে ছিলাম বোট নিয়ে গিয়ে পানি থেকে তাদের উদ্ধার করি। এ সময় তারা খুব ক্লান্ত ছিলেন। একজন কথা বললেও অন্যজন ছিলেন নিস্তেজ।’
আকাশে বিমান জ্বলছে। প্যারাশুট দিয়ে ঝাঁপ দিলেন দুই পাইলট। প্রাণ হারালেন একজন। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে ভিডিও করেছেন কেউ কেউ। সেটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমন ঘটনা, এমন মৃত্যুতে শোকের মাতম চলছে প্রাণ হারানো পাইলটের সহকর্মী, সহপাঠী আর স্বজনদের মধ্যে।
কেউ কেউ ফেসবুকে নিহত স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের শিক্ষা ও কর্মজীবনের অসামান্য অর্জনের ছবিগুলো দিয়ে শোক জানাচ্ছেন। কেউবা আবার বাবা-মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে আর্তি জানাচ্ছেন। বেদনা জাগানো এসব স্মৃতি ছুঁয়ে যাচ্ছে সবার হৃদয়।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর পতেঙ্গায় বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর রাশিয়ান প্রশিক্ষণ বিমান ওয়াইএকে-১৩০ কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত হয়। এ সময় বিমানটির পেছনে আগুন জ্বলতে দেখেন স্থানীয়রা। সেটি পতেঙ্গা বোট ক্লাবের কাছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের বিপরীতে এইচ এম স্টিল মিলের সামনে পড়ে নদীতে তলিয়ে যায়। বিধ্বস্ত বিমান থেকে প্যারাশুট দিয়ে বেরিয়ে আসা দুই পাইলটকে কর্ণফুলী নদীতে চলাচলরত নৌকার মাঝিরা উদ্ধার করেন।
তারা হলেন- উইং কমান্ডার সুহান ও স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ আসিম জাওয়াদ। এদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় আসিম জাওয়াদকে নৌবাহিনীর ঈসা খাঁ ঘাঁটির হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সুহান বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটিতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। বিধ্বস্ত বিমানটি উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সকাল ১০টা ২৫ মিনিটের দিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি ওয়াইএকে-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। দুর্ঘটনার পর বৈমানিকরা জরুরি প্যারাসুট দিয়ে বিমান থেকে বের হয়ে আসেন। বিমানের দু’জন পাইলটকেই উদ্ধার করা হয়েছে।
বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটির ফোকাল পারসন স্কোয়াড্রন লিডার আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, রাত ৯টায় জহুরুল হক ঘাঁটিতে নিহতের জানাজা হয়েছে। এরপর হেলিকপ্টারে করে মরদেহ ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, আসিমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান। তারা মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবাররের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও শোক প্রকাশ করেছেন।
ঘনবসতি থেকে দূরে নিতে জীবনের ঝুঁকি নেন পাইলটরা
আইএসপিআরের সহকারী তথ্য অফিসার আয়শা ছিদ্দিকার সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিমানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর বড়ধরনের ক্ষতি এড়াতে বৈমানিকরা অত্যন্ত সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিমানটিকে বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। পতেঙ্গার বাসিন্দা মো. পারভেজ বলেন, ‘বিমানটি পতেঙ্গা এলাকায় বিধ্বস্ত হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতো। নদীতে পড়ায় বড়ধরনের ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া গেছে।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানটির পাইলটরা প্যারাশুট দিয়ে নেমে এলে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে প্রথমে নৌবাহিনী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের মৃত্যু হয়। তার অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল। উদ্ধারের পরেও তার রেসপন্স ছিল না। আহত উইং কমান্ডার সুহান বর্তমানে জহুরুল হক ঘাঁটির মেডিকেল স্কোয়াড্রনে চিকিৎসাধীন আছেন।’
নিহত আসিম জাওয়াদ মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার গোপালপুর গ্রামের ডা. মো. আমান উল্লাহর ছেলে। তার মা নীলুফা আক্তার খানম সাভার ক্যান্টমেন্ট বোর্ড স্কুলের শিক্ষিকা। ৩২ বছর বয়সী আসিম জাওয়াদ মৃত্যুকালে স্ত্রী রিফাত অন্তরা, এক কন্যা, এক ছেলে ও বাবা-মাসহ অসংখ্যগুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
আসিমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্ট বোর্ড স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার মা এই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। এরপর সাভার ক্যান্টমেন্ট বোর্ড স্কুলে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন। সপ্তম শ্রেণিতে তিনি সাভার ক্যান্টমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি ও ২০০৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগ দেন আসিম। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর ক্যাডেটদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান সোর্ড অব অনার নিয়ে জিডি শাখায় কমিশন লাভ করেন।
চাকরিকালে তিনি বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি ও ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি পেশাদারী দক্ষতা ও সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘মফিজ ট্রফি’, ‘বিমান বাহিনী প্রধান ট্রফি’ ও বিমানবাহিনী প্রধানের প্রশংসাপত্র লাভ করেন। এ ছাড়াও ভারতীয় বিমান বাহিনীতে কোর্সে অংশ নিয়ে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘চিফ অব এয়ার স্টাফ’স ট্রপি ফর বেস্ট ইন ফ্লাইং (ভারতীয় বিমান বাহিনী)’ অর্জন করেন। চাকরিকালে তিনি দেশে বিদেশে বিভিন্ন ট্রেনিং কোর্স সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন।
আগেও তিন প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়
২০১৭ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার উপজেলার কাইশ্যাঘোনা এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর একইদিনে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে একটি পুটিবিলা এলাকায় এবং অপরটি ছোট মহেশখালীতে। এসব ঘটনায় পাইলটরা আহত হলেও কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
জানা গেছে, বিধ্বস্ত তিন প্রশিক্ষণ বিমানই ছিল রাশিয়ার তৈরি এবং ওয়াইএকে-১৩০ মডেলের। সর্বশেষ পতেঙ্গায় বিধ্বস্ত হওয়া বিমানও একই মডেলের।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম