পিছিয়ে থাকা পাহাড় এবার এগোল, গণিত কমাল জিপিএ-৫
১২ মে ২০২৪ ১৭:৫৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে গত তিন বছরের চেয়ে এবার জিপিএ-৫ কমেছে। এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলেছেন, গণিত ও উচ্চতর গণিতে শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছিয়ে থাকায় প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে। তবে এবার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়। প্রতিটি জেলায় পাসের হার গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
রোববার (১২ মে) দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চলতি বছর অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে শুরু হয়েছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর, তিন পার্বত্য জেলা এবং কক্সবাজার মিলিয়ে এবার পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৭৫৩ জন। উপস্থিত ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ২৪ জন।
প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, চলতি বছরে পাস করেছে এক লাখ ২০ হাজার ৮৭ জন। পাসের হার ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর আগে ২০২৩ সালে পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২০ সালে ৮৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৭৮ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৮৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ছিল ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে পাসের ক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে এবার আমাদের পরীক্ষার্থীরা ভালো করেছে। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সাল— এ তিন বছর কোভিড মহামারির জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছিল। তিন বছর পর ২০২৩ সালে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। এবারও পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে।’
‘আমাদের যদি তুলনা করতে হয়, তাহলে সর্বশেষ দুটি পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষার হিসেবে এবার ফলাফল ভালো হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছিল। ২০১৯ ও ২০২৩ সালের ফলাফলের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, তাহলেও এবার পাসের হার সন্তোষজনক,’— বলেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
এবার ১৭ হাজার ৭৭০ জন পরীক্ষার্থী এক বিষয়ে ফেল করেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিটি বিষয়েই ৯০ শতাংশের ওপরে পরীক্ষার্থী পাস করেছে।
জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে এবার কমেছে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ হাজার ৮২৩ জন, যার মধ্যে ছাত্রীরাই আছে এগিয়ে। পাঁচ হাজার ৭৫০ জন ছাত্রী জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। বিপরীতে ছাত্ররা জিপিএ-৫ পেয়েছে পাঁচ হাজার ৭৩ জন। বিজ্ঞানে ৯ হাজার ৫৮৯ জন, মানবিকে ১৩৭ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এক হাজার ৯৭ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
এর আগে ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১১ হাজার ৪৫০ জন, ২০২২ সালে পেয়েছিল ১৮ হাজার ৬৬৪ জন। ২০২১ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল মোট ১২ হাজার ৭৯১ জন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে আট হাজার ৫০২ জন, ২০১৭ সালে আট হাজার ৩৪৪ জন, ২০১৮ সালে আট হাজার ৯৪ জন, ২০১৯ সালে সাত হাজার ৩৯৩ জন ও ২০২০ সালে ৯ হাজার আটজন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
এ এম এম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতে সার্বিকভাবে পরীক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। তবে একেবারে খারাপ হয়েছে বলা যাবে না, সেখানেও ৯০ শতাংশের ওপরে পাস করেছে। সেখানে যদি পাসের হারটা শতভাগ কিংবা কাছাকাছি হতো, তাহলে জিপিএ-৫ আরও বাড়ত। আমাদের শিক্ষার্থীরা গণিত অনুশীলনের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, স্কুলে পর্যাপ্তসংখ্যক বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করে মানসম্মত পাঠদানের বিকল্প নেই।’
ফলাফলে দেখা গেছে, সাধারণ গণিতে ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং উচ্চতর গণিতে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করেছে। আর কোনো বিষয়ে এত পরীক্ষার্থী ফেল করেনি।
জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থী বিবেচনায় শীর্ষস্থানে থাকা বিদ্যালয়গুলোর কোনো তালিকা শিক্ষা বোর্ড প্রকাশ করেনি। তবে ২৫টি বিদ্যালয়ে কতজন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে, সেটা প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে দেখা গেছে, কলেজিয়েট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। ওই প্রতিষ্ঠানের ৩৭৬ জন, ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৩২ জন, সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১৫ জন, নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ ২৪৭ জন, নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪১ জন, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৩৫ জন, চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২২৪ জন, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১২ জন, বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৮৭ জন, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের ১৫৯ জন, অপর্ণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৪৩ জন ও কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৪২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, যথারীতি ছাত্রদের তুলনায় চট্টগ্রামে ছাত্রীরা এগিয়ে আছে। এবার মোট ৮১ হাজার ৪৪৩ জন ছাত্রী ও ৬৩ হাজার ৫৮১ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল। ছাত্রীদের মধ্যে পাসের হার ৮৩ দশমিক ২১ শতাংশ, ছাত্রদের মধ্যে ৮২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
পাসের দিক থেকে এবারও এগিয়ে বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থীরা। বিজ্ঞানে ৯৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৮৪ দশমিক ১১ শতাংশ ও মানবিকে পাসের হার ৭৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীন পাঁচ জেলা ও মহানগরে এবার পাসের হার গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। চলতি বছর চট্টগ্রাম মহানগরীর বিদ্যালয়গুলোতে পাসের হার ৮৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। মহানগর বাদে জেলায় পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
কক্সবাজার জেলায় পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৭২ দশমিক ৭২ শতাংশ। খাগড়াছড়ি জেলায় পাসের হার ৭২ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং বান্দরবান জেলায় ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
গত বছর চট্টগ্রাম মহানগরের স্কুলগুলোতে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মহানগর বাদে চট্টগ্রাম জেলায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ১০ শতাংশ। কক্সবাজার জেলায় ৭৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৬৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাগড়াছড়ি জেলায় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং বান্দরবান জেলায় ৭০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার ২১৯টি কেন্দ্রে এক হাজার ১২৫টি বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরা এবার এসএসসিতে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে শত ভাগ পাস করেছে, এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৫টি। পাসের হার শূন্য, এমন কোনো বিদ্যালয় নেই।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাহাড়ের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা এগিয়ে গেছে। এটা একটা ভালো দিক। এর কারণ হিসেবে আমরা যেটা ধারণা করছি, কোভিড মহামারিকাল কাটিয়ে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এখন যে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দূরত্ব ও দুর্গম এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় পাহাড়ে সাধারণত পরীক্ষাকেন্দ্র পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ অনেকক্ষেত্রে যে স্কুলের শিক্ষার্থী, সে স্কুলেই তার পরীক্ষাকেন্দ্র হয়। পরিবেশেরও একটা ইতিবাচক প্রভাব আছে।’
গত এক দশকের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এবারই পাহাড়ের পরীক্ষার্থীরা তুলনামূলক এগিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
এসএসসি পরীক্ষা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড জিপিএ-৫ পাসের হার পাহাড়ের শিক্ষার্থী