‘মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছি’
১৪ মে ২০২৪ ২০:৪১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি অবস্থায় সর্বক্ষণ মৃত্যুভয় তাড়া করেছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের। সবসময়ই গুলিভর্তি অস্ত্র তাদের মাথায় তাক করে রাখত জলদস্যুরা। মুক্ত নাবিক তানভীর আহমেদ বললেন, ‘মনে হতো, যেকোনো সময় ট্রিগারে চাপ পড়বে। এই বুঝি বড় ধরনের অ্যাকসিডেন্ট ঘটে গেল! এই বুঝি মারা পড়লাম! বলা যায়, মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছি।’
মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) জেটিতে পৌঁছানোর পর এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সোমালিয়ার জলদস্যুদের ওপর চাপ তৈরি করতে শুরু থেকে এর কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ন্যাভাল ফোর্সের একটি যুদ্ধজাহাজ। সামাজিকমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে এ সংক্রান্ত ছবিও প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। তানভীর আহমেদ জানাচ্ছেন, ওই যুদ্ধজাহাজের অবস্থান নেওয়ার পরপরই সোমালিয়ান জলদস্যুরা হিংস্র আচরণ শুরু করে। ওই সময় জিম্মি নাবিকদের মধ্যে মৃত্যুভয় কাজ করছিল অনেক বেশি মাত্রায়।
তানভীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন ইউএস নেভি শিপ আমাদের জাহাজের কাছাকাছি আসতে থাকে, তখন ওরা (জলদস্যু) আমাদের ঘিরে ফেলে। জাহাজের ভেতরে আমাদের একটি জায়গায় জড়ো করে রাখে। মাথার ওপর অস্ত্র ধরে রাখে। তখন জলদস্যুরা আমাদের বলেছিল, নেভি শিপ থেকে যদি আক্রমণ করা হয়, তাহলে তারা আমাদের কাউকে রেহাই দেবে না। তারা আমাদের সামনে রাখবে, যেন নেভি শিপ থেকে গুলি করলে আমাদের গায়ে লাগে।’
আরও পড়ুন- ৬৪ দিনের উৎকণ্ঠার অবসান, স্বজনের বুকে ২৩ নাবিক
‘ওই সময় শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল, মৃত্যু একেবারে কাছে’— এমন মন্তব্য করে তানভীর বলেন, ‘আসলেই আমরা ভয় পেয়ে গেছিলাম। এবং স্বীকার করতেই হবে, আমাদের মৃত্যুভয় পেয়ে বসেছিল। সবাই কান্না শুরু করে দেয়। বলা যায়, আমরা মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছি।’
জিম্মি অবস্থাতেও সারাক্ষণ মৃত্যুভয় তাড়া করত উল্লেখ করে জাহাজটির এ প্রকৌশলী বলেন, ‘বন্দি অবস্থায় লোড করা বন্দুক আমাদের মাথায় ধরে রাখত। আমাদের মনে হতো, যেকোনো সময় ট্রিগারে চাপ পড়বে। এই বুঝি বড় কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল! এই বুঝি মারা পড়লাম! বলা যেতে পারে, মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছি।’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও পরক্ষণেই অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। দুয়েকজন কৌশলে মোবাইল রেখে দিতে পেরেছিল। সেটা দিয়ে যোগাযোগ করতাম সবাই। পরিবারকে কেউ বুঝতে দিত না, সবাই সুন্দরভাবে কথা বলতাম। কিন্তু কথা শেষ করেই অনেকে ইমোশনাল হয়ে যেত, কান্নায় ভেঙে পড়ত।’
‘আমাদের একেকটা দিন যে কীভাবে গেছে, সেটা আমরা বলে বোঝাতে পারব না। প্রতি মুহূর্তে আজকের দিনটার জন্য ওয়েট করেছি। কখন দেশের মাটিতে ফিরব, কখন পরিবারের কাছে ফিরব, সেজন্য ওয়েট করেছি। ফিরতে পারব, এমন নিশ্চয়তা তো ছিল না। আগেই বলেছি, মৃত্যুকূপ থেকে ফিরেছি,’— বলেন ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ।
এর আগে মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেল ৪টায় ২৩ নাবিককে বহন করা জাহাজ এমভি জাহান মনি-৩ তিনটি টাগবোটের পাহারায় চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে পৌঁছে। সকালে কুতুবদিয়া উপকূল থেকে নাবিকদের নিয়ে রওনা দেয় জাহাজটি।
নাবিকদের প্রতীক্ষায় থাকা স্বজনরা সকাল থেকেই ভিড় করেছিলেন এনসিটি-১ জেটিতে। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান সবাই প্রিয় স্বজনটির জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন। নাবিকরা জেটিতে পৌঁছার পর সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, জাহাজের প্রতিষ্ঠান কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাতসহ কর্মকর্তারা তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেন।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজটি কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের দিকে যাচ্ছিল। পথে জাহাজটি দখল করে জলদস্যুরা ২৩ নাবিককে জিম্মি করে।
মুক্তিপণ পরিশোধের পর গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা ৮ মিনিটে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এর পরপরই জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের পথে রওনা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রিত উপকূল থেকে সোমালিয়ার সীমানা পার করে দেয়।
জাহাজটি ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৪টায় আল হামরিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। পরদিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় নোঙর করে জেটিতে। সেখানে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খালাসের পর ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সেটি চুনাপাথর বোঝাই করার জন্য মিনা সাকার বন্দরে যায়। চুনাপাথর বোঝাই শেষে আরব আমিরাতের ফুজাইরা বন্দর থেকে জ্বালানি নিয়ে ৩০ এপ্রিল দেশের পথে পাড়ি দিতে শুরু করে এমভি আব্দুল্লাহ।
জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তির একমাস পর সোমবার (১৩ মে) দুপুরে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় কক্সবাজারে পৌঁছে জাহাজটি। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সেটা কুতুবদিয়ায় পৌঁছে নোঙর ফেলে। জাহাজটিতে নতুন নাবিক পাঠানো হয়। লাইটারেজ জাহাজে চড়ে নতুন নাবিকদের একটি দল জাহাজটির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন ওই ২৩ নাবিক।
নাবিকরা চট্টগ্রামে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে ৬৪ দিনের শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের অবসান হয়েছে। নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটেছে।
আরও পড়ুন-
- চোখে পানি, মুখে হাসি | ছবি
- বাবার সঙ্গে ঈদ করতে চায় আসফিয়া
- ‘ওরা যেদিন মুক্ত হবে সেদিনই আমাদের ঈদ’
- জাহাজেই ফিরবেন ২৩ নাবিক, চলছে কয়লা খালাস
- ‘পাশ ফিরলেই দেখি বড় বড় গান তাক করে রেখেছে’
- সাইদুজ্জামান জিম্মি সোমালিয়ায়, বাড়িতে ঈদ রঙহীন
- ৩১ দিন পর জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহ
- বন্দুকের নলের মুখে ঈদের নামাজ, পরিবারের জন্য হাসিমুখে ছবি
- চাপ-অভিযান নয়, জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে সমঝোতায় জোর
- জলদস্যুদের হাতে জিম্মি সাইদুজ্জামান, ঈদের আনন্দ নেই পরিবারে
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জিম্মি নাবিক নাবিকদের প্রত্যাবর্তন সোমালিয়ান জলদস্যু