‘পাউবোর ব্যর্থতায় রক্ষা করা গেল না বাঁধটি’
৩০ মে ২০২৪ ০৮:৩৫
খুলনা: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) মিথ্যা আশ্বাস আর কত? এবার স্থায়ী সমাধানের বাঁধ চাই। আর ভাসতে চাই না, এবার বাঁচতে চাই। উপকূলের কান্না কী সরকার শুনতে পায় না? বারবার বলেও লাভ হলো না। হাজারও মানুষের চেষ্টাতেও হয়নি শেষ রক্ষা। ফের হাজারও কৃষকের স্বপ্ন চোখের পলকে ভেসে গেল।
বুধবার (২৯ মে) এমন হতাশাপূর্ণ কথাগুলো বলছিলেন কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করতে আসা উপকূলের স্থানীয় লোকজন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে এই বাঁধটি এবার ফের ভেঙে গিয়েছিল। নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বাঁধটি মেরামত করছিলেন। কিন্তু সেই মেরামত শেষ হতে না হতেই জোয়ারের পানিতে বাঁধটি ফের ভেঙে গেছে।
স্থানীয়রা শুনেছিলেন যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমানকে রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তারা অপেক্ষায় ছিলেন, প্রতিমন্ত্রী বেড়িবাঁধে গিয়ে তাদের কথা শুনবেন। বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি মানুষের দুঃখ নিজ চোখে দেখবেন। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকেই দেখেছেন বিভিন্ন এলাকা। এরপর কয়রা সদরে মতবিনিময় করে চলে গেছেন।
দশালিয়া গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, এভাবেই সবসময় তাদের ফাঁকি দেওয়া হয়। একটি টেকসই বাঁধের অভাবে বছরের পর বছর ধরে তাদের অস্তিত্বের সংকটে পড়তে হয়। কিন্তু তারা কোনো সমাধান পান না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কেবল অবহেলা মেলে।
কয়রা উপজেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) টিম লিডার জি এম আব্দুল্লাহ আল মামুনের ডাকে ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে উপজেলার কপোতাক্ষ নদের ভাঙা বেঁড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করছিলেন এলাকার কয়েক হাজার অধিবাসী। তবে কাজ শেষে হতে না হতেই শুরু হয় জোয়ার। তারা বাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেই মেরামত করা বাঁধ ছাপিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকতে থাকে। তারা দেখতে পান, জোয়ারে বাঁধের আরেক পাশ ভেঙে গেছে। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে ফের লবণাক্ত পানি ঢুকছে গ্রামে। ফের পানিবন্দি হয়ে পড়েন হাজার হাজার মানুষ।
জোয়ারের পর নোনা পনিতে ডুবন্ত জনপদে পরিণত হয়েছে মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়াসহ কয়েকটি গ্রাম। নদের পাড়ের চিংড়ি ঘেরগুলোর অস্তিত্ব আর নেই। পানি ঢুকে পড়েছে বসতি, জনপদে। বারবার একই স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যর্থতাকেই দুষছেন স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, গত বছর এই বাঁধ নির্মাণ করার পরই নিচু হয়ে যায় এবং বালি ভর্তি জিও বস্তা সরে চলে যায়। এমনকি সেখানে ভাঙতে ভাঙতে বাঁধ সরু হয়ে যায়। বারবার অনুরোধ করার পরও সেটি রক্ষণাবেক্ষণ বা মজবুত করার ব্যবস্থা নেয়নি পাউবো কর্তৃপক্ষ। এতে দুর্বল বাঁধ আবারও ভেঙেছে।
সকালে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য শাহাদাৎ হোসেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পাউবো কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাঁধ নির্মাণের সব উপকরণ তারা জোগান দেবেন, যদি আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে পারি। সেই আশ্বাসে আমাদের সিপিপি টিম লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুনের ডাকে আমরা হাজারও মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁশ, বস্তা পেরেক দিলেও বালি ভরাব জন্য জিও বস্তার টপ দেয়নি। তারা বললেন, আপনারা কাজ করেন, ওগুলো আসছে। কিন্তু তা আর আসেনি।’
শাহাদাৎ আরও বলেন, ‘আমরা বাঁশ দিয়ে ক্লোজারে খাঁচা করে বস্তায় মাটি ভরে ফেলতে থাকি। কিন্তু তারা শুধু বলছে, জিও বস্তা ট্রলারে করে আসছে। দুঃখের বিষয়, শেষ পর্যন্ত আর ওই বালি ভরাটের জন্য বাল্কহেড আর বাঁধের পাশে পৌঁছায়নি। বাল্কহেড এসে যদি বাঁধে বালি ভরে টিউব দিতে পারত, তাহলে আর বাঁধটা নতুন করে ভাঙত ন।’
একই গ্রামের স্বপন কুমার মিস্ত্রী বলেন, ‘এই বাঁধ কতবার ভাঙবে? আর কতবার স্বেচ্ছাশ্রমে ঠিক করব? প্রতিবার ভাঙনের পর পাউবোর কর্মকর্তাসহ অনেক বড় বড় ব্যক্তি পরিদর্শনে আসেন। দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়ে চলে যান। পরে আর তাদের খোঁজ থাকে না। সরকারিভাবে এখনো বাঁধ রক্ষায় ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রামবাসীর উদ্যোগে বাঁধ রক্ষায় কাজ করেও বাঁধ টিকিয়ে রাখা যায়নি।’
উপজেলা সিপিপি টিম লিডার জি এম আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু ক্ষোভ জানিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বাঁধ মেরামত কাজের সব উপকরণ দেওয়ার কথা ছিল। সে আশ্বাস পেয়ে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করছিল। কিন্তু টিউবে বালি ভরার বাল্কহেড না আসায় কাজে বাধা পড়ে। পাউবো সরঞ্জাম যা কিছু দিয়েছিল, সেগুলো নগণ্য। তাই যথেষ্ট মানুষ মিলে কাজ করার পরও নদীতে প্রবল জোয়ার থাকায় আর বাঁধ টেকেনি। প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বি এম তারিক-উজ-জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় নদীর পানি অনেক বাড়ছে। এতে দশালিয়ার যে বাঁধটি মেরামত করা হচ্ছিল, তা আবার ভেঙে গেছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা সুলায়মান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের মাধ্যমে পানি আটকানোর জন্য মানুষ কাজ শুরু করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে বস্তা-বাঁশ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু ঠিক করা থাকলেও বাল্কহেড কোনো কারণে আসতে পারেনি। তাছাড়া অস্বাভাবিক প্রবল জোয়ার ছিল। এর কারণেই এক পাশ থেকে বাঁধ ভেঙে যায়।’
এর আগে বুধবার দুপুরে খুলনা কয়রা কপোতাক্ষ ডিগ্রি কলেজ মাঠে উপজেলার ঘুর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান।
অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছি। দুর্যোগে যথাসময়ে প্রস্তুতির ফলে মানুষের দুর্দশা লাঘব, জীবন ও সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়েছে। পূর্ব প্রস্তুতি ছিল বলেই সর্বনিম্ন ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে বড় ধররর দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পেরেছি। অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রায় ছয় শ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেন।
অনুষ্ঠানে খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান, ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান, খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুকুল কুমার মৈত্র উপস্থিত ছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বি এম তারিক-উজ-জামান।
সারাবাংলা/টিআর