Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘শয়তানের নিঃশ্বাস’— আতঙ্ক ছড়ালেন ওসি, লাগাম টানল সিএমপি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ জুন ২০২৪ ২০:১২

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিংয়ে ১৩ দিন আগে তিন যুবক মিলে কৌশলে পথচারী এক নারীর কাছ থেকে সোনার গহনা ও টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই নারী পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন, তিন যুবক বিশেষ কিছু ব্যবহার করে তার চিন্তাশক্তি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার কাছ থেকে গহনা-টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

অভিযোগ পাওয়ার পর ডবলমুরিং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ব্যবহার করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ডবলমুরিং থানা নামের অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টে ‘ধারণার ভিত্তিতে’ তিনি লিখেন, ‘শয়তানের নিঃশ্বাস এখন চট্টগ্রামে। বুদ্ধিনাশক বিষ শয়তানের নিঃশ্বাস হতে সতর্ক থাকুন।’ ওসি’র এ বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর ভিত্তিতে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়, চট্টগ্রামে অপরাধী চক্র ‘স্কোপোলামিন’ জাতীয় রাসায়নিকের ব্যবহার শুরু করেছে। যা শয়তানের নিঃশ্বাস হিসেবে পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

এতে তৈরি হয় আতঙ্কজনক পরিস্থিতি ও নানামুখী আলোচনা। সেই আতঙ্ক ছড়ানোর লাগাম টানতে ১৩ দিন পর তৎপর হয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে সিএমপি বলছে, ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ ব্যবহার করে প্রতারণার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

গত ২২ মে সকালে নগরীর নগরীর ডবলমুরিং থানার বেপারিপাড়া মোড়ে পথচারী এক নারীর কাছ থেকে তিন যুবক মিলে গলার চেইন, কানের দুল, হাতে থাকা বাজার ও টাকা হাতিয়ে নেয়। ২৮ মে ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারী ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর সেটি জানাজানি হয়।

ওসি’র ভাষ্য অনুযায়ী, ওই নারী বেপারিপাড়া মোড়ে সবজি কিনতে যান। ফেরার পথে রাস্তায় পেয়ে দুই যুবক গিয়ে তাকে বলেন, ‘খালা আপনার বাসার আশেপাশে কোনো গরিব লোক বা ফ্যামিলি আছে কি-না, থাকলে আমরা টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করব। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য। আমরা আপনাকে টাকা দিচ্ছি, আপনি আপনার এলাকার গরিব লোকদের দিয়ে দিবেন।’

বিজ্ঞাপন

ওসির পোস্ট থেকে জানা যায়, ওই নারী সামনে এগোতেই দুজনের একজন তার হাতে থাকা লেবু দিয়ে তার পিঠ স্পর্শ করে। লেবুর স্পর্শে তিনি পেছন ফিরে তাকাতেই অপর ব্যক্তি তার হাতে থাকা একটি লেবু তার নাকের সামনে এনে ফুঁ দেয়। ফুঁ নাকে লাগতেই ফাতেমা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন, নিজ বুদ্ধিশুন্য হয়ে যান, নিজে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তাৎক্ষণিক সেখানে আরও এক ব্যক্তি এসে বলেন – ‘আন্টি, আপনার কানে দুল, গলায় চেইন আছে, আপনি ওগুলো খুলে আমাদের দেন।’

বুদ্ধিশক্তি হারানো ফাতেমা তার গলার চেইন, কানের দুল খুলে তাদের দেন। হাতে থাকা সবজির ব্যাগও তাদের হাতে তুলে দেন বলে ওসির পোস্টে উল্লেখ আছে।

একই পোস্টে ওসি ঘটনায় জড়িত তিন যুবককে ‘দুষ্কৃতকারী শয়তানের নিঃশ্বাস ছড়ানোকারী দল’ অভিহিত করে লিখেন, ‘নারীর নাকের কাছে স্কোপোলামিন ছড়িয়ে দিয়ে তার চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় অপরাধীরা। স্কোপোলামিনের প্রয়োগে চিন্তা-বুদ্ধি শক্তি হারিয়ে অপরাধীরা যা করতে বলেছে তাই করেছেন। ঘটনার কিছুক্ষণ পরে ফাতেমা তার নিজের বুদ্ধিশক্তি ফিরে পেয়ে সন্তান-স্বামীসহ থানায় এসে জানান ঘটনাটি।’

এদিকে, নারীর অভিযোগ পাওয়ার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ একজনকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার মো. জনি (৩০) খুলনা সদর উপজেলার বাসিন্দা। তবে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার মধ্যম হালিশহরে।

জানা গেছে, ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারীর ফেসবুক পোস্ট ও কয়েকটি গণমাধ্যমের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নজরে আসে সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়ের। কমিশনারের নির্দেশে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) নিহাদ আদনান তাইয়ান ওই নারীর অভিযোগ এবং স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিঃশ্বাস ব্যবহারের আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি না সেটা তদন্ত করেন।

জানতে চাইলে উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আক্রান্ত নারী অভিযোগ করেছেন, একটা লেবু উনার নাকের সামনে এনে ফুঁ দিয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা এর কোনো সত্যতা পাইনি। উনাকে বিশেষ কিছু প্রয়োগ করে অজ্ঞান কিংবা মতিভ্রম করার চেষ্টা করেছে, এমন প্রমাণও ফুটেজে নেই। এটা ওই নারীর শুধুমাত্র মৌখিক অভিযোগ। আমরা বারবার উনাকে বলেছি, মেডিকেল এক্সামিনের জন্য। সেটাতে উনি কোনোভাবেই রাজি হননি। তখন আমাদের সন্দেহ হয়।’

তিনি বলেন, ‘যে আসামি গ্রেফতার হয়েছে, সে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে জানিয়েছে, তারা তিনজন মিলে ওই নারীকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলেছিলেন। সোনা-টাকা দিলে দ্বিগুণ ফেরত দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। ওই নারী নিজেই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। গ্রেফতার যুবক মলম কিংবা অজ্ঞান পার্টির সদস্য- এমন কোনো তথ্যপ্রমাণও পাওয়া যায়নি। সম্পূর্ণ ধারণা বা কল্পনাপ্রসূত একটি বিষয় নিয়ে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিষয়টি উদঘাটনের পর সিএমপির পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে।’

সিএমপির মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বুদ্ধিনাশক বিষ বা অন্য কিছু প্রয়োগ করে কানের দুল, গলার চেইন, নগদ টাকা, মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ করে ডবলমুরিং থানায় ঘটনার শিকার নারী মামলা দায়ের করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ঘটনায় জড়িত একজনকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গ্রেফতার হওয়া আসামি এবং আরও দুজন মিলে সুকৌশলে ভিকটিমকে অতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্ররোচিত করে তার কাছ থেকে কানের দুল, গলার চেইন, নগদ এক হাজার টাকা, মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে বুদ্ধিনাশক স্কোপালামিন প্রয়োগ হতে পারে বলে ধারণা করা হলেও তদন্তে এখন পর্যন্ত ‘স্কোপালামিন’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণেও এ বিষয়ে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

সিএমপি বলছে, শয়তানের নিঃশ্বাস বা কোনো কেমিক্যাল নয়, বরং একটি প্রতারক চক্র মানুষকে অতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এ ধরনের কাজ করছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। শয়তানের নিঃশ্বাস ব্যবহারে প্রতারণা বা এ ধরনের তথ্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ করেছে সিএমপি।

সত্যতা নিশ্চিত না করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিকটিমের অভিযোগের ভিত্তিতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। উনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই লিখেছি। ধারণার ভিত্তিতে শয়তানের নিঃশ্বাসের বিষয়টি লেখা হয়েছিল।’

সিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) নিহাদ আদনান তাইয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে বাদী যেভাবে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, সেভাবেই হয়তো ওসি ফেসবুকে লিখেছেন। মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেই হয়তো তিনি দিয়েছেন। উনাকে এক্ষেত্রে দোষী বলা যাবে না। তবে যেসব বিষয় সাধারণত জনমনে আতঙ্ক কিংবা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে, সেগুলো নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

শয়তানের নিঃশ্বাস সিএমপি স্কোপালামিন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর