ঘরে বসেই কোটি কোটি টাকা ছাপাতেন ‘গুরু জাকির’
৮ জুন ২০২৪ ১৮:০২
ঢাকা: রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কদমতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি জাল নোট তৈরি চক্রের মূলহোতাসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগ।
শনিবার (৮ মে) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুটি বাসায় অভিযান শেষে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
গ্রেফতার চার জন হলেন- লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে ‘মাজার জাকির’ ওরফে ‘গুরু জাকির’ (৪০), তার দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ বেগম (২৫), লিমা আক্তার রিনা (৪০) ও সাজেদা আক্তার (২৮)।
মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘বাজারে পাওয়া ২২ এমএম সাদা কাগজ কালার প্রিন্টারে দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জাল টাকা ও ভারতীয় মুদ্রা তৈরি করে আসছিল চক্রটি। চক্রের মূলহোতা জাকির ১২ বছর ধরে ৫০০ ও এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করে আসছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেন সন্দেহ করতে না পারেন সেজন্য বর্তমানে ১০০ ও ২০০ টাকার জাল নোট তৈরি করতেন। ঈদুল আজহা টার্গেট করে চক্রটি বিপুল পরিমাণ জাল নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।’
সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, অভিযানে দুটি বাসা থেকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা এবং আরও প্রায় তিন কোটি জাল টাকা তৈরির বিশেষ কাপড়/কাগজ, বিশেষ ধরনের কালি, ল্যাপটপ, চারটি প্রিন্টার, বিভিন্ন সাইজের কয়েক ডজন স্ক্রিন/ডাইস, সাদা কাগজ, হিটার মেশিন, নিরাপত্তা সুতাসহ জাল টাকার হরেক রকম মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার জাল টাকার মধ্যে ২০০, ৫০০, ১০০০-এর নোট ও ভারতীয় ৫০০ রুপি রয়েছে।
মশিউর রহমান বলেন, ‘২৫ বছর ধরে জাল টাকার খুচরা ও পাইকারি কারবারের পাশাপাশি বিভিন্ন মানের জাল টাকা ও জাল রুপি তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ লিয়াকত হোসেন জাকির। তিনি ২০১২ সাল থেকে ৫০০ ও এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করলেও বর্তমানে সাধারণ মানুষ যেন সন্দেহ করতে না পারেন সেজন্য বড় নোটের পাশাপাশি ১০০ ও ২০০ টাকার জাল নোটও তৈরি করতেন।’
তিনি বলেন, ব‘র্তমানে কাগজ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের কালি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় জাকির এক হাজার টাকার ১০০টি নোটের বান্ডেল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। গত ১২ বছরে জাকির কখনো জাল টাকা খুচরায় বিক্রি করেননি। নারী-পুরুষ মিলে তার প্রায় ১৫/২০ জন কর্মচারী আছেন, যাদের মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতন দিতেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা ব্যক্তি পর্যায়ে জাল টাকা বিক্রি করলে ধরা পড়তে পারেন, সেই ঝুঁকি এড়াতে অনলাইনে (বিশেষত ফেসবুক ও মেসেঞ্জার) দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কুরিয়ারের মাধ্যমে জাল নোট বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন তারা।’
লালবাগের ডিসি বলেন, “একবার জাল নোট তৈরির সময় জাকিরের সহযোগীরা গ্রেফতার হলে তিনি মাজারে মাজারে অবস্থান করতেন। মাজারের কচ্ছপ, মাছের খাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে তাকে ‘মাজার জাকির’ বলা হয়। অপরদিকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় জাল নোটের ছোট ছোট ঘরোয়া কারখানা স্থাপনকারীরা জাকিরের কাছ থেকে কারিগরি, সফট কপি, পরামর্শ এমনকি মডেল জাল রুপি নিয়ে থাকেন বলে জাকিরকে ‘গুরু জাকির’ বলেও চেনেন অনেকে।”
মশিউর রহমান বলেন, ‘গত রোজার ঈদের আগে জাকিরের জাল নোটের দুই পাইকারি ক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার এক নারীকে গ্রেফতার করা হয়। এই নারী মাদকের একটি মামলায় কারাগারে গিয়ে জাল নোট চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এর পর জামিনে এসে জাল টাকার কারবার শুরু করেন। ঈদকে সামনে রেখে তিনি বিপুল পরিমাণ জাল নোট কেনার জন্য এসেছিলেন। তার সূত্র ধরে জাকিরকে গ্রেফতার করা হয়।’
জাল নোট প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও আন্তরিক হওয়ার তাগিদ দিয়ে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘সারাবছর গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে হয়। নানান ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। কারণ, চক্রগুলো সারাবছরই জাল নোট তৈরি করছে। কয়েকদিন আগে এক নারীই ৫০ লাখ জাল টাকা নিয়েছেন জাকিরের কাছ থেকে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, তারা কী পরিমাণ জাল নোট বাজারে ছাড়ছেন। চক্রে ১৫ থেকে ২০ জন এজেন্ট রয়েছেন, যারা সারাদেশে জাল টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গরু-ছাগল বিক্রি বা লেনদেনের সময় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে টাকা যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।’
জাল নোট তৈরি চক্রের মূলহোতা জাকির
চক্রের মূলহোতা ও জাল নোট তৈরির কারিগর জাকিরের বিষয়ে ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘জাল নোট তৈরির কারিগর হিসেবে জাকির অত্যন্ত দক্ষ। তার চক্রে বহু নারী ও পুরুষ রয়েছেন। এইসব কর্মচারীকে মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বেতন দেন তিনি। জাকির যে বাসায় অবস্থান করে জাল নোট বানাতেন সেই বাসার আশপাশে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি করতেন যেন তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরতে না পারে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলেই তিনি পালিয়ে যেতেন।’
গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে জাল টাকার মামলার বিচারে দ্রুত বিচার আদালত নেই। ফলে দীর্ঘসময় ধরে বিচারকাজ চলায় আসামিরা কারাগার থেকে জামিন পেয়ে ফের একই কাজে জড়িয়ে যান। চক্রের মূলহতা জাকির ডিএমপিসহ দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত ছয়বার গ্রেফতার হয়েছেন। এরপরও তিনি একই কাজ চালিয়ে আসছিলেন।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম