কাংরাজ-ওলবাড়ি, টুইন টাওয়ার– গরুর রাজ্যে মানুষের ভিড়
১২ জুন ২০২৪ ১২:২৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মাথায় বিশালাকৃতির দুই শিং। দুধসাদা রংয়ের সঙ্গে হালকা ধূসরের মিশেল। স্বভাবে চটপটে। মাথা উঁচু করে রাখা রাজকীয় ভাবসাব। রাজস্থানের এই ‘বাহুবলী’ খামারের অন্যদের চেয়ে দৃশ্যত ভিন্ন। মালিকের যত্নআত্তিও অন্যদের চেয়ে আলাদা। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান।
প্রায় ৭০০ কেজি ওজনের কাংরাজ প্রজাতির গরুটি প্রতিদিন শত, শত দশনার্থীর নজর কাড়ছে। মঙ্গলবার (১১ জুন) সকালে নগরীর পলিটেকনিক মোড় এলাকার এশিয়ান অ্যাগ্রো ফার্মে গিয়ে গরুটির দেখা মেলে।
ভারতের রাজস্থানের কাংরাজ প্রজাতির এই একটি গরুই আছে ওই খামারে। তবে অন্যান্য প্রজাতি মিলিয়ে খামারটিতে অন্তত ২০০ গরু রয়েছে। যার মধ্যে ১৭৮টিই বিক্রি হয়ে গেছে। আছে ৬৫০ কেজি ওজনের ইন্ডিয়ান ওলবাড়ি ষাঁড়, ৬০০ কেজি ওজনের অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান ও ক্রস ব্রাহামা প্রজাতির গরু। গরুগুলোকে সামনে রেখে কেউ মোবাইলে সেলফি তুলছেন, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে নিচ্ছেন ছবি।
খামারটির মালিকপক্ষ জানিয়েছে, কাংরাজ প্রজাতির গরুটির দাম হাঁকা হয়েছিল ২০ লাখ টাকা। ১০ দিন আগেই ১৭ লাখ টাকা দিয়ে এটা চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী কিনেছেন। ওলবাড়ি ষাঁড়ের দাম হাঁকা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। ৬০০ কেজি ওজনের অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ানের জন্য ১২ লাখ ও ব্রাহামা ক্রসের জন্য ১১ লাখ টাকা দাম হাঁকা হয়েছে।
এশিয়ান অ্যাগ্রোর তত্ত্বাবধায়ক মো. ইব্রাহিম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে গরুর দাম ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু। সবচেয়ে দামি ছিল কাংরাজ প্রজাতির গরুটি। সেটা বিক্রি হলেও আমাদের এখানে রাখা হয়েছে। কাল-পরশুর দিকে সেটা ডেলিভারি হয়ে যাবে। প্রতিবছর আমরা ২০০ থেকে ২৫০ গরু কোরবানির জন্য তৈরি করি। গত বছর ২২০টি গরু ছিল। সেখান থেকে মাত্র ১৩ টি গরু ছাড়া বাকি সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।’
মানুষ কেন খামারের গরুর দিকে ঝুঁকছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘খামার থেকে গরু কিনলে সেটা কোরবানি ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এখানে রাখা যায়। আলাদাভাবে কোনো খাবার খরচ দিতে হয় না। সব খামারেই এ সুযোগ আছে। এ ছাড়া, খামারে উন্নতমানের খাবার খাওয়ানো হয়। পুরো পরিবার নিয়ে খামারে এসে পছন্দ করে গরু কেনা যায়, যে আনন্দ হাটে পাওয়া যায় না। তাই মানুষ খামারেই গরু কিনতে পছন্দ করছে বেশি।’
খামারে হাটের চেয়ে অতিরিক্ত দাম নেওয়া হচ্ছে বলে ক্রেতাদের অভিযোগ রয়েছে- এ প্রসঙ্গে এশিয়ান অ্যাগ্রোর তত্ত্বাবধায়ক মো. ইব্রাহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘খামারে গরুদের সব উন্নতমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এখন পশুর খাবারের দাম অনেক বেশি। তাছাড়া খামার ও গরুর দেখভাল করার জন্য আলাদাভাবে মানুষ রাখতে হয়। সেখানেও একটি খরচ আছে। প্রতি মাসে একবার প্রত্যেক গরুকে পশু ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে যায়। এ কারণেই খামারের গরুর দাম একটু বেশি।’
১১ বছর বয়সী ওয়াজেদ বাবার সঙ্গে গরু দেখতে এসেছিল এশিয়ান অ্যাগ্রোতে। এত বড় বড় গরু দেখে তার চোখ যেন ছানাবড়া। পাশে থাকা বাবাকে নিয়ে কখনও গরুর কাছে গিয়ে আদর করে দিচ্ছে, আবার কখনও কৌতূহল মনে প্রশ্নে করছে, ‘বাবা গরু কি করে এত বড় হয়?’
গরু কিনতে এসেছো কি?- এমন প্রশ্নে ওয়াজেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত বড় গরু কেনার জন্য অনেক টাকা লাগবে। বাবার এত টাকা নেই। আমরা ছাগল দিয়ে কোরবানি দেবো।’
ওয়াজেদের বাবা আবদুল হাকিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি পেশায় ড্রাইভার। গরু দিয়ে কোরবানি করার সামর্থ এখনও আমার হয়নি। ছেলে অনেকদিন ধরে বলছিল গরু দেখতে হাটে যাবে। হাটে বড় গরু তেমন নেই। তাই ছেলেকে নিয়ে খামারে এসেছি বড় গরু দেখাতে। এত বড় গরু সে আগে দেখেনি। তাই সে অনেক খুশি।’
১৪ মণ ওজনের ‘টুইন টাওয়ারের’ দাম ১২ লাখ টাকা
এশিয়ান অ্যাগ্রো থেকে বের হয়ে একটু হেঁটে গেলেই দেখা মিলবে চৌধুরী র্যাঞ্চ অ্যাগ্রোর। এখানেও শাহীওয়াল ও দেশি ষাঁড় গরুর পাশাপাশি আছে তিনটি কাংরাজ প্রজাতির গরু রয়েছে। এর মধ্যে একটি ডিসপ্লের জন্য রাখা হলেও অন্য দু’টি বিক্রির জন্য। যাদের দাম হাঁকা হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে গরু দু’টির জন্য ১৮ লাখ পর্যন্ত দাম উঠলেও মালিকপক্ষ সেগুলো বিক্রি করেননি।
চৌধুরী র্যাঞ্চ অ্যাগ্রোতে ঢুকলেই যে কারও চোখে পড়বে কুচকুচে কালো রঙ এর অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের ১৪ মণ ওজনের একটি গরুর। আদর করে এর নাম দেওয়া হয়েছে টুইন টাওয়ার। আট লাখ টাকা দাম উঠলেও টুইন টাওয়ারকে বিক্রি করেননি মালিকপক্ষ।
গরুটির পরিচর্যা করেন খামারটির কর্মচারি বাবুল মিয়া। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘টুইন টাওয়ারকে প্রতিদিন মিক্স দানাদার ও ঘাস খাওয়ানো হয়। এছাড়া আপেল, গাজরসহ বিভিন্ন ফলমূলও তাকে খাওয়ানো হয়। গরম সহ্য করতে না পারায় তার জন্য আলাদা পাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।’
খামারের তত্ত্বাবধায়ক জুয়েল রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আকর্ষণের মধ্যে আছে তিনটি কংরাজ প্রজাতির গরু। এ ছাড়া, কালো রংয়ের টুইন টাওয়ারকে দেখতে অনেকে আসে। এটা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের জন্য আনা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আরেক জায়গা থেকে কিনবেন বলে শুনেছি।’
৩ লাখ টাকার নিচে গরু নেই ইউনিক্যাম অ্যাগ্রোতে
৫৮ বছর বয়সী সাখাওয়াত হোসেন তার তিন ছেলেকে নিয়ে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার ইউনিক্যাম অ্যাগ্রোতে এসেছিলেন কোরবানির গরু কিনতে। ছেলেরা রাখালদের দিয়ে এক এক করে তিনটি বড় শাহীওয়াল তার সামনে আনেন। কিন্তু রং পছন্দ না হওয়ায় তিনটি গরুকেই তিনি ফের ভেতরে পাঠিয়ে দেন। এরপর লাল রংয়ের আরেকটি শাহীওয়াল আনা হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি গরুটি পছন্দ করেন এবং সেটা নিয়ে দরদাম করতে বলেন ছেলেদের।
প্রায় ৪৫০ কেজি ওজনের শাহীওয়াল ষাঁড়টির দাম হাঁকা হয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা। অনেক দর কষাকষির পর ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় গরুটি কিনে নেন তিনি। সাখাওয়া হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছরও এখান থেকে গরু কিনেছিলাম। খামারের মালিক আমার ছেলের পরিচিত। তিন বছর আগেও হাটে গিয়ে গরু কিনেছি। এখন সব জায়গায় খামার হয়ে যাওয়ায় অনেক সুবিধা হয়েছে। এসে পছন্দ মতো গরু কেনা যায়। কোনো ঝামেলা নেই। আমি সবসময় লাল গরু কোরবানি দিই। এবারও পছন্দ করে লাল গরু কিনলাম।’
ইউনিক্যাম অ্যাগ্রোর সত্ত্বাধিকারী আবদুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে এবার যেসব গরু কোরবানির জন্য তোলা হয়েছে প্রায় সবগুলোর দাম তিন লাখ টাকার ওপর। এর চেয়ে কম দামের গরুও আমাদের খামারে আছে। তবে সেগুলো আগামী কোরবানিতে তোলা হবে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে ছোট-বড় প্রায় ৪০০টি অ্যাগ্রো ফার্মের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে মাফ অ্যাগ্রো লিমিটেড, ক্লিপটন গ্রুপের অজি ডেইরি অ্যান্ড অ্যাগ্রো, এনকেআরএল অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, শাহ আমানত অ্যাগ্রো, এফএ অ্যান্ড অ্যাগ্রো, তাজউয়ার অ্যাগ্রো, আরবিস অ্যাগ্রো ফার্ম, রাজ অ্যাগ্রো, চাটগাঁইয়া অ্যাগ্রো, সাজেদা অ্যাগ্রো, সারা অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড, শেঠ অ্যাগ্রো অন্যতম।
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটোকরেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম