শেষ দিনে ‘পানির দামে’ গরু বিক্রি
১৬ জুন ২০২৪ ২০:২৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাজারে প্রচুর গরু, ক্রেতার সমাগম তেমন নেই। বিক্রেতারা সস্তায় ছেড়ে দিয়েছেন গরু। তাদের ভাষায়, পানির দামে গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। ঈদুল আজহার আগের দিন, অর্থাৎ পশুর হাটের শেষ দিনের চিত্র এমনই।
রোববার (১৬ জুন) বিকেলে নগরীর ‘এক কিলোমিটার’ এলাকায় নুরনগর হাউজিং সোসাইটি মাঠে পটিয়া থেকে আসা গরু বিক্রেতা মো. বেলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বদ্দা, অবস্থা কেরোসিন (ভালো নয়)। পাঁচটা গরু এনেছিলাম। দুই লাখ সত্তর হাজার করে দাম চেয়েছিলাম। গত চার দিন বিক্রি হয়নি। আজ শেষ দিনে এসে চারটা বিক্রি করে দিয়েছি। দুই লাখ টাকা করে নিতে কষ্ট হয়েছে। আরেকটা আছে। যা পাই, বেচে দিয়ে চলে যাব।’
নুরনগরের মতো, একই অবস্থা নগরীর বিবিরহাট, দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোডের সিডিএ বালুর মাঠ এবং স্টিল মিল গরুর বাজারেও। এসব বাজারে শেষ দিনে যারা গরু কিনেছেন, তারা সস্তায় পেয়ে খুশি। আর বিক্রেতাদের চেহারা মলিন। তারা জানিয়েছেন, একেকটি গরু ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা কম দামে তারা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিপুল গরুর বিপরীতে ক্রেতা না থাকায় এবং বড় গরুর চাহিদা না থাকায় সস্তায় তাদের গরু বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
নুরনগর মাঠের বিক্রেতা জোবায়ের সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরু যা বিক্রি হওয়ার গত রাতে হয়ে গেছে। এখন যারা বাজারে আসছে, তারা আসলে ঘুরতে আসছে। গরু যা কেনার তারা কিনে ফেলেছে। আমরাও বিক্রি করে দিচ্ছি। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দাম ধরে রাখলে বাকিগুলো বেচতেই পারব না। তাই লস না করে কম লাভে বিক্রি করলাম।’
নগরীর হামজারবাগের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বিবিরহাট বাজার থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছেন। মাঝারি এ লাল গরুটি আগের দিনও দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দাম চেয়েছিলেন বিক্রেতা।
নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন বাজারের যে অবস্থা তার সঙ্গে তুলনা করলে মনে হচ্ছে জিতেছি। বাজার ডাউন। কাস্টমার নাই। আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম, যে পরিমাণ গরু এসেছে সে পরিমাণ বিক্রি হবে না। এ জন্য শেষ দিনেই গরু কিনব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আজ সস্তায় পেলাম।’
আউটার রিং রোডের সিডিএ বালুর মাঠে গত দুদিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে মাঝারি ও ছোট গরু। বড় গরু যারা এনেছেন, তাদের দিকে ক্রেতাদের নজর নেই।
বালুর মাঠ গরুর বাজারের দায়িত্বে থাকা মো. হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে এ হাটে গরু কেনাবেচা চলছে। সবচেয়ে বেশি গরু বিক্রি হয়েছে গতকাল (শনিবার) রাতে। কম দামেই ব্যাপারিরা গরু ছেড়ে দিয়েছেন। দেড় শ থেকে দুই শ গরু বিক্রি হয়েছে শুধু গত রাতেই। বেশিরভাগ ছোট ও মাঝারি গরু। রোববার সকাল থেকে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কাস্টমার না পেয়ে দুপুর থেকে আবার দাম ছেড়ে দিয়েছে।’
নগরীর হালিশহর থেকে ওই বাজারে গিয়েছিলেন ওষুধ বিক্রেতা রইসুদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন তার ছোট ভাই ও এক ছেলে। ভিড় পছন্দ না করায় ভোরের নামাজ পড়েই গরু কিনতে বাজারে যান তিনি।
রইসউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) বিকেলে বিবিরহাটে গিয়েছিলাম। ছোট ও মাঝারি গরুর অনেক দাম ছিল। দুই মণের একটি গরুর দাম নাকি এক লাখ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। এক লাখের নিচে গরুই পাওয়া যায়নি। বিকেলে বালুর মাঠে আসি। সেখানেও একই অবস্থা। মাঝারি গরুর দাম দেড় লাখ টাকার ওপর। একদিন অপেক্ষা করে আজ (রোববার) বালুর মাঠ থেকে একই গরু এক লাখ দিয়ে কিনেছি।’
সাজ্জাদ ইসলাম নামে আরেক ক্রেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাঝারি চারটি গরু কিনেছি। আজ (রোববার) ঠিক দামেই পেয়েছি।’
স্টিল মিল বাজারে মো. মাসুদ নামে এক বিক্রেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফরিদপুর থেকে গত দুই বছর ধরে এখানে আসছি। চট্টগ্রামে গরুর দাম পাওয়া যায় না। আগামীবার আর আসব না। পাঁচটি গরু এনেছিলাম। বিক্রি করে দিয়েছি। দাম পেলাম না।’
ফরিদপুর থেকে ১৮টি গরু নিয়ে নুরনগর হাউজিং মাঠে এসেছিলেন মো. সিরাজ। তিনি সারাবাংলাকে জানান, শনিবার পর্যন্ত তিন দিনে ১৭টি গরু বিক্রি করেছেন, প্রতিটি এক লাখ ৬০ হাজার টাকায়। শেষ দিনে আরেকটি গরু এক লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। লাভ কম হলেও সন্তুষ্ট সিরাজ।
ফরিদপুর থেকে একই বাজারে ৭০টি গরু নিয়ে আসা বিলাল গাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরুর দাম আজ এত পড়ে গেছে, গতকালের (শনিবার) চেয়ে একেকটি গরু ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। গরু আছে, কাস্টমার নেই। আরও ১৪-১৫টা গরু রয়ে গেছে। সব দিকেই ধরা খেলাম।’
কুমিল্লার চান্দিনা থেকে আসা বিক্রেতা মো. সুমন বলেন, ‘দুই লাখ ৪০ হাজার টাকায় যে গরু বিক্রি করতে চেয়েছি, সেগুলো দুই লাখও কেউ দিতে চাচ্ছে না। এক লাখ ৮০ হাজার পর্যন্ত উঠেছিল। বিক্রি করে দিয়েছি।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলা ও মহানগরী মিলিয়ে এবার স্থায়ী ৭২টি ও অস্থায়ী ১৭৬টি কোরবানি পশুর হাট বসে। উপজেলাগুলোর মধ্যে ফটিকছড়িতে ৪৫টি, মীরসরাইয়ে ২৭টি, হাটহাজারীতে ২৩টি, সন্দ্বীপে ২০টি, লোহাগাড়া, রাঙ্গুনিয়া ও রাউজানে ১৬টি করে, সীতাকুণ্ডে ১৪টি, বাঁশখালীতে ১২টি, আনোয়ারায় ১১টি, বোয়ালখালীতে ১০টি, পটিয়া ও চন্দনাইশে ৯টি করে, সাতকানিয়ায় ছয়টি এবং কর্ণফুলী উপজেলায় চারটি হাট বসে। চট্টগ্রাম নগরীতে সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে বসে মোট ১০টি পশুর হাট।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরী মিলিয়ে এবার সাড়ে আট লাখ থেকে পৌনে ৯ লাখ পশু কোরবানির সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে পাঁচ লাখ ২৬ হাজারের মতো গরু, ৭০ হাজার মহিষ এবং বাকিগুলো ছাগল ও ভেড়া। গরু ও অন্যান্য পশু মিলিয়ে এবার মজুত ছিল আট লাখ ৫২ হাজার।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/টিআর