হঠাৎ কেনা বন্ধ করে দরপতন, চামড়া ফেলতে হলো সড়কে
১৮ জুন ২০২৪ ২২:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আড়তদারদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটবাজির অভিযোগ তুলে পাঁচ বছর আগে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সড়কে ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের মৌসুমি সরবরাহকারী ও খুচরা বিক্রেতারা। গত কয়েক বছরে তারা অনেকটা নিষ্ক্রিয়ই হয়ে পড়েছিলেন। এ বছর আবার কোরবানির সময় তারা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তবে লাভ হয়নি, পাঁচ বছরের পুরনো চিত্রই আবার ফিরে এসেছে চট্টগ্রামে। সড়কে ফেলে দেওয়া হলো কাঁচা চামড়া।
মৌসুমি সংগ্রহকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। ফলে লোকসান দিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নষ্ট হয়ে যাওয়া ১০ হাজারেরও বেশি চামড়া রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সোমবার (১৭ জুন) ঈদুল আজহার সকালে শুরু হয় পশু কোরবানি। দুপুর থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চামড়া কেনাবেচা ছিল বেশ সুশঙ্খল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউছিয়া কমিটি স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মৌসুমি সংগ্রহকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের অনেককে নগরীর আতুরার ডিপোতে সরাসরি আড়তে নিয়েও কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে দেখা যায়। আবার আড়তদারের প্রতিনিধিদেরও নগরীর চৌমুহনী এলাকার কর্ণফুলী মার্কেটসহ চামড়া সংগ্রহের কয়েকটি স্পটে ঘুরে চামড়া কিনতে দেখা যায়।
- ৬০০ টাকার বেশি দাম ওঠেনি গরুর চামড়ার
- সর্বনিম্ন দাম হাজার টাকায় চামড়া বিক্রি হবে?
- কোরবানির চামড়ার মৌসুমি ক্রেতা নেই, দানই ভরসা
- টানা ৪ বছর বাড়ছে, তবু চামড়ার দাম এক যুগ আগের দুই-তৃতীয়াংশ
- চামড়া বাজারে এবারও ধস, জয়পুরহাটের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিপাকে
- ‘বদনাম’ ঘোচাতে চান আড়তদাররা, জানালেন চামড়া সংরক্ষণের খরচ
কিন্তু সোমবার মধ্যরাতের পর দৃশ্যপট পালটে যায়। জানা গেছে, প্রথম ধাপের কাঁচা চামড়া সংগ্রহের পর আড়তদারের প্রতিনিধিরা মাঠ থেকে ‘উধাও’ হয়ে যান। আড়তদাররাও চামড়া কেনার গতি শ্লথ করে দেন। মঙ্গলবার (১৮ জুন) ভোরের দিকে আবার আড়তদার ও তাদের প্রতিনিধিরা সক্রিয় হলেও ততক্ষণে মৌসুমি সংগ্রহকারী ও খুচরা বিক্রেতারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। চামড়াও নষ্ট হওয়ার উপক্রম। এরপর আড়তদারদের নির্ধারিত দামেই তারা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন। অনেকে সেই ভোরে রাগে-দুঃখে ও হতাশায় সড়কের ওপর চামড়া ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যান।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চৌমুহনী কর্ণফুলী মার্কেট, বিবিরহাট গরুবাজারের সামনে এবং আতুরার ডিপো এলাকায় সড়কে কেউ কেউ কাঁচা চামড়া ফেলে গেছেন। এগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা সেগুলো বর্জ্যের সঙ্গে সংগ্রহ করে ডাম্পিং জোনে নিয়ে গেছি। খুব বেশি চামড়া নষ্ট হয়নি, চৌমুহনী থেকে দুই-চার হাজারের মতো, সব মিলিয়ে বড়জোড় ১০ হাজার হতে পারে।’
কর্ণফুলী মার্কেটের কাঁচামাল ব্যবসায়ী হাসিব মোল্লা কোরবানির পর দুপুরে ১৪০ পিস কাঁচা চামড়া নিয়ে ওই মার্কেটের সামনে বিক্রির জন্য হাজির হয়েছিলেন। তিনি জানালেন, গড়ে ৪৫০ টাকা করে কেনা প্রতিটি কাঁচা চামড়া তিনি রাত ১১টার দিকে ৩৮০ টাকা দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তার ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয় একদল মৌসুমি সংগ্রহকারী ৮০০ পিস চামড়া নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো বিক্রির দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাসিব। ভোর ৫টার দিকে সেগুলো ১২০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি করে দেন, যদিও সেগুলো কেনা হয়েছিল ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে। কর্ণফুলী মার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী একই দরে ২৫০ পিস চামড়া কিনে বিক্রি করতে বসেছিলেন। তাকেও ভোরের দিকে প্রতিটি চামড়া ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করে বাড়ি চলে যেতে হয়েছে।
হাসিব মোল্লা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সন্ধ্যার পর্যন্ত আড়তদারের লোকজন ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় চামড়া কিনেছে। ৫০০ টাকাতেও কিনেছে। সন্ধ্যার পর আমরা অনেক খুঁজেও তাদের পাচ্ছিলাম না। আমি চামড়া ধরে রেখে ভুল করেছি। রাত ১১টার দিকে বিক্রি করে দিয়েছি। আমাকে ৩০ হাজার টাকা নগদ দিয়েছে, ২০ হাজার টাকার চেক দিয়েছে। চেকের টাকা আদৌ পাবো কি না, কে জানে! আমার ২০ হাজার টাকা লস হয়েছে। চামড়াগুলো বিক্রি করে না দিলে পচে যেত।’
শুধু চৌমুহনী এলাকায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার অন্তত আড়াই হাজার পিস কাঁচা চামড়া সড়কে ফেলে যাওয়ায় নষ্ট হয়েছে বলে দাবি হাসিব মোল্লার। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চামড়ার ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে। আগে আমরা তিন হাজার টাকায় চামড়া কিনে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করতাম। দুই হাজার টাকায় চামড়া কিনে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করতাম। এখন চামড়ার দাম দেড়-দুই শ টাকা। চামড়ার ব্যবসা না করলে কী হয়! এ সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন আমি আর চামড়ার ব্যবসা করব না।’
চৌমুহনী এলাকায় কাঁচা চামড়ার বড় ক্রেতা চট্টগ্রাম দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি মোহাম্মদ ইয়াসিন ৫০০ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নিয়ে চৌমুহনী এলাকায় বসেছিলেন। ‘দরের কারসাজি’ হবে বুঝতে পেরে তিনি সন্ধ্যার আগেই চামড়া সংগ্রহ বন্ধ করে দেন। ৩২০ পিস চামড়া তিনি রাত ১টার দিকে প্রতি পিস ২০০ টাকায় বিক্রি করে দেন।
ইয়াসিনের প্রতিনিধি মোহাম্মদ ছগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘৫০০ থেকে ৬৫০ টাকায় চামড়া কিনে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ৬০ হাজার টাকা লস করেছি। গাউছিয়া কমিটির লোকজন পাড়ায়-পাড়ায় লিল্লাহ ফান্ডের জন্য বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করেছে। সেই চামড়া তারা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করেছে। শুনেছি, একজন আড়তদারের কাছে ৬০ হাজারের মতো চামড়া তারা বিক্রি করেছে। আরও কয়েকজন আড়তদারের কারও কাছে দুই হাজার, কারও কাছে আড়াই হাজার এভাবে করে বিক্রি করেছে। সস্তায় কাঁচা চামড়া পেয়ে আড়তদার আর আমাদের দিকে আসেনি।’
চৌমুহনী-বাদামতল-ছোটপোল এলাকা মিলে চার হাজারেরও বেশি চামড়া বিক্রি না হওয়ায় নষ্ট হয়ে দাবি করে ছগীর বলেন, ‘একেকজনের তিন-চার লাখ টাকা লস হয়েছে। এ ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা এ ব্যবসা আর করব না।’
এর আগে ২০১৯ সালে আড়তদার ও তাদের প্রতিনিধিরা ‘অস্বাভাবিক দরপতন’ ঘটিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ রেখেছিলেন। এতে কাঁচা চামড়া সড়কে ফেলে দিয়ে তাদের বিদায় নিতে হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার বছর মৌসুমি সংগ্রহকারীদের আর তৎপরতা ছিল না। কিন্তু এ বছর আবার চট্টগ্রাম নগরীর কিছু কিছু এলাকায় মৌসুমি সংগ্রহকারীরা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন। চৌমুহনী কর্ণফুলী মার্কেট এলাকায় কোরবানির পর দুপুরে চামড়া নিয়ে আসা তরুণদের কয়েকটি দলকে দেখা গিয়েছিল।
২০১৯ সাল পর্যন্ত মৌসুমি সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কিনে খুচরা বিক্রেতারা আড়তদারের প্রতিনিধির কাছে অথবা সরাসরি আড়তে বিক্রি করতেন। মাঠ থেকে মৌসুমি সংগ্রহকারী উধাও হওয়ার পর একদিনের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী খুচরা বিক্রেতার সংখ্যাও কমে আসে।
চার বছর পর ফের সক্রিয় হওয়া মৌসুমি সংগ্রহকারীদের আবার ‘শিক্ষা দিয়ে’ মাঠ থেকে ‘আউট’ করতে আড়তদারদের সিন্ডিকেট এ কারসাজি করেছে বলে দাবি খুচরা বিক্রেতাদের কয়েকজনের।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সহসভাপতি আব্দুল কাদের জানিয়েছেন, ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার (১৮ জুন) দুপুর পর্যন্ত কোরবানি দেওয়া গরু, মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। এর মধ্যে গরু প্রায় পৌনে দুই লাখ। এ ছাড়া গাউছিয়া কমিটির কাছে আরও ষাট হাজারের মতো চামড়া আছে।
আড়তদার সমবায় সমিতির টার্গেট সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহ। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭৫ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। কাদের জানান, চট্টগ্রামে ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত কোরবানি হয়। এ ছাড়া নগরীর সব এলাকা ও উপজেলা থেকে এখনো সব চামড়া আড়তে পৌঁছায়নি। অনেকে আড়তে না এনে সরাসরি ট্যানারি মালিকের কাছে বিক্রি করবেন। সব মিলিয়ে তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে তিনি আশাবাদী।
দর নিয়ে কারসাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আব্দুল কাদের সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বড় চামড়া ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা এবং ছোট চামড়া ৩০০ টাকায় কিনেছি। দর নিয়ে কারসাজির অভিযোগ কেউ করতে পারবে না। আতুরার ডিপোতে একটা চামড়াও নষ্ট হয়নি। চৌমুহনীতে কেউ কেউ চামড়া ফেলে গেছে বলে শুনেছি। বেশি দাম পাওয়ার আশায় কেউ চামড়া বিক্রি না করে রেখে দিলে এবং পরে সেটা যখন নষ্ট হওয়া শুরু হবে, তখন ফেলে দিলে আমাদের তো কিছু করার নেই।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
ঈদুল আজহা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী কোরবানির পশু কোরবানির পশুর চামড়া গাউছিয়া কমিটি চামড়া চামড়া ব্যবসায়ী চামড়া সংরক্ষণ চামড়ার দাম ট্যানারি লবণছাড়া চামড়া লবণযুক্ত চামড়া সিন্ডিকেট সিন্ডিকেটবাজি