চীনের ‘ইন্ধনে’ পুতিন-কিম বন্ধুত্ব, পশ্চিমে ‘উদ্বেগ’
২১ জুন ২০২৪ ১২:৫৮
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক উত্তর কোরিয়া সফর আলোচনা ছড়িয়েছে সারা বিশ্বেই। বিশেষ করে এই সফরে সই হওয়া একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনেক বেশি সাড়া ফেলেছে, যেখানে পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার প্রধান নেতা কিম জং উন সম্মত হয়েছেন যে তাদের দেশ দুইটির বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসনে তারা পরস্পরকে সহায়তা করবেন।
২০০০ সালের এবারই প্রথম পিয়ংইয়ং সফর করলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ যে সম্পর্ক, এই সফরকে সেই সম্পর্ক প্রদর্শনীর একটি সুযোগ হিসেবে নিয়েছে দুই দেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিন ও কিম সেই কাজটি সফলভাবেই করতে পেরেছেন। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পরস্পরের পাশে থাকা এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে কিমের পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা তারই প্রতিফলন।
এই সফরের পর পুতিন ও কিম যেভাবে একই সুরে কথা বলেছেন, তা পশ্চিমা বিশ্বের কপালে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। একই সঙ্গে দুই দেশের শীর্ষ দুই নেতার এই বন্ধনের পেছনে চীনের ‘ইন্ধন’ দেখছে পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার পারস্পরিক এই সম্পর্ক পশ্চিমাদের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত বুধবার (১৯ জুন) উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে পৌঁছান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিমানবন্দরে লাল গালিচায় তাকে স্বাগত জানান উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। দুই দিনের সফর শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ জুন) উত্তর কোরিয়া ছেড়েছেন পুতিন। সেখান থেকে ভিয়েতনাম গেছেন তিনি।
সফরে কিমের সঙ্গে একান্ত বৈঠকের পর পরস্পরের প্রতি সমর্থনের ঘোষণা দেন পুতিন। অন্যদিকে কিম বলেন, এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। এতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
বিবিসির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিন ও কিম প্রকৃতপক্ষে বুঝতে পেরেছেন যে তাদের পারস্পরিক সহায়তা প্রয়োজন। একদিকে রাশিয়া যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য তাদের প্রয়োজন অস্ত্র। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা উত্তর কোরিয়ার জন্য প্রয়োজন অর্থ। এ প্রেক্ষাপটই মূলত দুই দেশকে একত্রিত করেছে।
অন্যদিকে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দ্বিপাক্ষিক এই সম্পর্ককে কৌশলগত দিক থেকেও সতর্ক থাকতে হয়েছে। কেননা উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী চীন ওই এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ। চীনের সঙ্গে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া দুই দেশেরই সুসম্পর্ক রয়েছে। তারপরও রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক যেন চীনের জন্য জন্য কোনো ধরনের উসকানি বা উদ্বেগের কারণ না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হয়েছে। কেননা বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে থাকে চীনই।
এ অবস্থায় বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর মিলেছে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান সখ্যে খুব একটা সন্তুষ্ট নন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, গত মাসে শি ও পুতিনের বৈঠকের পর বেইজিং সরাসরিই পুতিনকে বলেছিল যে তিনি যেন পিয়ংইয়ং সফরে না যান।
বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক আরও তাৎপর্যপূর্ণ। ইউক্রেনে আগ্রাসনের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছিল চীন। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা হয়, এমন কিছু রাশিয়ার কাছে বিক্রি না করতে চীন চাপে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পক্ষ থেকে। ফলে ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা না জানালেও রাশিয়াকে সেভাবে সামরিক সহায়তা দিতে পারেননি জিনপিং।
এই সীমাবদ্ধতা অবশ্য কৌশলগত কারণেই মেনে নিতে হয়েছে চীনকে। কারণ তাদের বিশ্ববাজার প্রয়োজন নিজেদের পণ্য বিক্রি করার জন্য। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক ও বিনিয়োগও প্রয়োজন। কারণ তা না হলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির পক্ষে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। সে কারণেই ইউরোপের অনেক দেশসহ থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ সুবিধা দিচ্ছে চীন। দেশটির পান্ডা ফের বিদেশের চিড়িয়াখানায় দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও বজায় রেখে চলেছে বেইজিং। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কিম জং উন দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ করছেন। এ বিষয়ে জাতিসংঘে বারবার নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রতিবারই সেই প্রস্তাব ভেটো দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে চীন। এভাবে কিমের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কার্যক্রমকে রাজনৈতিক সুরক্ষা দিচ্ছেন জিনপিং। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিরও অন্যতম চালিকাশক্তি চীন।
দুই মিত্র দেশ রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দুই শীর্ষ নেতার একান্ত বৈঠক নিয়ে তাই বেইজিং আপত্তি জানালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, সেটি অনেকটাই লোক দেখানো আপত্তি। কারণ তারা নিজেরা রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা না দিতে পারলেও তাদের অনুমোদন নিয়ে উত্তর কোরিয়া ঠিকই রাশিয়ার কাছে সামরিক সরঞ্জামের বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে।
আবার অস্ত্র-গোলাবারুদের পরিবর্তে রাশিয়াও উত্তর কোরিয়ার কাছে ক্ষেপণাস্ত্রসহ পারমাণবিক অস্ত্র বা সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করতে পারে কি না, তা নিয়েও আলোচনা আছে। তবে সেখানেও মূল নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে চীন। কারণ উত্তর কোরিয়াকে সামরিক দিক থেকে অনেক বেশি সহায়তা হয়তো চীন মেনে নিতে চাইবে না।
ফলে এই তিন দেশের পরিস্থিতি বর্তমানে এমন— রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া দুই দেশের চীনের সমর্থন ও সহায়তা যেমন প্রয়োজন, তেমনি চীনেরও প্রয়োজন এই দুই দেশকে পাশে রাখা। কারণ রাশিয়া যেমন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনকে সমর্থন দেবে, তেমনি আঞ্চলিক ও ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের সমর্থন দেবে উত্তর কোরিয়া।
আবার উত্তর কোরিয়ার সিংহ ভাগ তেলই যায় রাশিয়া থেকে। উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধাস্ত্র সহায়তা একইভাবে এই সময়ে রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কেউই চীনকে পাশ থেকে হারাতে চাইবে না। ফলে রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে চীন অনেকটাই ভারসাম্যের নিক্তির মতো কাজ করছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা সত্ত্বেও রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক অনেকটা যুদ্ধকালীন অংশীদারিত্ব। তার সঙ্গে এই সম্পর্ক লেনদেনেরও। আর সেখানেই অন্যতম প্রভাবক চীনও।
অনেক বিশ্লেষকেরই ধারণা, চীনই এই দুই দেশকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে পেছন থেকে সম্পর্কের রাশও টেনে রেখেছে যেন তা চীনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার মতো ঘনিষ্ঠতার দিকে ধাবিত না হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ভারসাম্য বজায় থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি পশ্চিমাবিশ্বের জন্য যথেষ্টই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে থাকবে। কেননা এই তিনটি দেশ যখন নিজেদের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক সমর্থন দিতে থাকবে, তখন পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে এই দেশগুলোকে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েও আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
ভ্লাদিমির পুতিন, শি জিনপিং ও কিম জং উন তাই একসঙ্গে এক টেবিলে না বসলেও দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমেই পশ্চিমাদের উদ্বেগের কারণ বাড়িয়েই যেতে পারেন।
[বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএন অবলম্বনে]
সারাবাংলা/টিআর
আঞ্চলিক রাজনীতি উত্তর কোরিয়া কিম জং উন চীন ভূরাজনীতি ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়া শি জিনপিং