‘জিয়া রক্তাক্ত হাতেই খাবার খেতেন এবং ফাঁসির আদেশে সই করতেন’
২৬ জুন ২০২৪ ১৭:৩০
সংসদ ভবন থেকে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, খুনি জিয়া তো রক্তাক্ত হাতেই খাবার খেতেন। এবং খেতে খেতেই ফাঁসির আদেশে সই করতেন। জিয়ার আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঢাকা নগর ছাত্রলীগ নেতা মাহফুজ বাবু গুম হয়ে যায়, জিয়ার পেটোয়াবাহিনীর হাতে নিহত হয় চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ, যুবলীগের মুনিরসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী। জিয়া ইনডেমনিটি জারি করে জাতির পিতার খুনিদের রক্ষা করেছে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকুরি দিয়ে পুনর্বাসন করেছে।
বুধবার (২৬ জুন) জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রশ্নের জবাব টেবিলে উত্থাপন করেন তিনি। এ সময় অধিবেশনের সভাপতিত্ব করঠছিলেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুনি ফারুক-রশিদরা আগে থেকেই জাতির পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে- যেটা জিয়া জানতো। অথচ জাতির পিতাই মেজর জিয়াকে ১৯৭২ সালে কর্নেল এবং ১৯৭৩ সালে ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছরে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির চেয়ারে নিজেকে আজীবন আসীন করে রাখার বাসনা নিয়ে আইয়ুব খানের অনুকরণে সেনাছাউনিতে বসে দলছুট রাজনীতিবিদদের নিয়ে বিএনপি গঠন করে জিয়া। তিনি যেমন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন, তেমনি অবৈধভাবেই বিএনপি সৃষ্টি করেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর জন্ম হয়েছিল বন্দুকের নল দিয়ে রাতের অন্ধকারে। দলটির জন্ম অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের হাতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করে একাধারে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সংশ্লিষ্টতা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর দালাল আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ১১ হাজার রাজাকার ও আলবদরকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়। যুদ্ধাপরাধী দল জামাত ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে এনে এবং স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ ও আলীমকে মন্ত্রী বানিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের ছেড়ে দিয়ে তাদের পুনর্বাসন ও মন্ত্রী বানানোর মধ্য দিয়ে জিয়া প্রমাণ করেছে, সে পরাজিত শক্তির দালাল ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করতেন না। তার সাড়ে ৫ বছরের শাসনামলে ২১টি ক্যু/পাল্টা-ক্যু হয়। অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তাহেরকে সে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছিল। সার্বিক প্রেক্ষাপটে জিয়া অত্যন্ত হিংস্র ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতাবিরোধী জিয়াউর রহমান একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদ কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, “১৯৭৮ সালের জুনে তার নির্বাচন সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ছিল। ব্যাকডেটে সই করে সে তার সমস্ত প্রমোশন নিয়েছিল। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বারবার আমাদের পবিত্র সংবিধান কাঁটাছেঁড়া করেছিল। জিয়ার নির্দেশে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা স্বাধীন দেশের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। খুনি জিয়ার মানুষ হত্যার নমুনা আছে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘Bangladesh: A Legacy of Blood’ বইয়ে। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘সরকারি হিসাবমতে জিয়া ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দু’মাসের মধ্যে ১১৪৩ জন সৈনিককে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল।’ খুনি জিয়ার উত্তরসূরি স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও একই কায়দায় দেশ শাসন করেন।”
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমরাই স্বৈরাচারের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি। সেই সব আন্দোলনে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ ময়েজউদ্দিন, এইচ এম ইব্রাহিম সেলিম, কাজী দেলোয়ার হোসেন, নূর হোসেনসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অজস্র নেতাকর্মীদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে আমরা সরকার গঠন করতে পারতাম। কিন্তু আমি মনে করেছিলাম, যখন অ্যাবসল্যুট মেজরিটি পাব তখনই সরকার গঠন করব। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া সরকার গঠন করে। যে তার স্বামীকে অনুসরণ করে যুদ্ধাপরাধী নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে উপহার দেয় লক্ষ শহিদের রক্তে ভেজা জাতীয় পতাকা। বঙ্গাবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি রশীদ ও হুদাকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে এমপি বানিয়ে খালেদা জিয়া প্রমাণ করেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে তার আত্মার আত্মীয়তা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোটের দুঃসহ অত্যাচার নির্যাতনের সেই বিভীষিকাময় দুঃসময়ের কথা। যা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিহিংসার জঘণ্য কালো অধ্যায় হিসেবে মানুষ মনে রাখবে। ২০০১ সালে কারচুপির নির্বাচনে জনগণের ভোট কেড়ে নিয়ে বিএনপি-জামাত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। নির্বাচনের রাত থেকেই শুরু করে আওয়ামী লীগ নিধন অভিযান। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে ভোলার চর অন্নদা প্রসাদ গ্রামে এক রাতে শতাধিক নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। গফরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীর ভিটাবাড়ি কেটে পুকুর বানানো হয়। গফরগাঁওয়ে একরাতে হাজারো নারী ধর্ষণ করা হয়েছিল। স্বামীকে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনে বরিশালে গৌরনদীর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সাবিত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে একরাতে ৭০টি পরিবারের মেয়েদের গণধর্ষণ করা হয়। এমনকি পঙ্গু শেফালিও রক্ষা পায়নি।’
তিনি বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি-জামাতের দুঃশাসন, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদী কার্যক্রম এবং দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দমননীতির ফলে দেশের অবস্থা চরম বিপর্যন্ত ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ছিল। বিএনপির জঙ্গিবাদী মদদে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, বাংলা ভাই ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। তারা দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তাণ্ডবলীলা চালাতে থাকে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালিপাড়ায় আওয়ামী লীগের জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা এবং ৮৪ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে। আল্লাহতালার অশেষ রহমতে আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবন দিতে হয় আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মীকে। এ ছাড়া পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন এবং অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। শুধু আমার উপরেই ১৯ বার হত্যাচেষ্টায় হামলা করেছে। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার এমপি, সাবের এমপি ও মমতাজউদ্দিনসহ ২১ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। বগুড়ায় মসজিদে কোরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় আমাদের কৃষকলীগ নেতা আজমকে হত্যা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বানচাল ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে বিএনপি-জামাত জোট সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তাদের সন্ত্রাসীদের সহিংস হামলা, পেট্রোল বোমা, অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন শত শত নিরীহ মানুষ। তারা শত শত গাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং ভাঙচুর করেছে হাজার হাজার গাড়ি। মহাসড়কসহ গ্রামের রাস্তার দু’পাশের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। সরকারি অফিস, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফুটপাতের দোকান এমনকি নিরীহ পশুও তাদের জিঘংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি।’
বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় না। জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সে ক্ষমতায় আসে নাই। সে যে হ্যাঁ-না ভোট দিয়েছিল সেটা অবৈধ ছিল। না-ভোট খুঁজে পাওয়া যায় নাই। ১০০ শতাংশের উপরে ভোট পড়েছিল। খালেদা জিয়ার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, বিদেশিদের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আরোহণ, ২০০৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে ১/১১ এর মতো রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। ওরা কখনোই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসতে পারেনি। এমনকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কখনোই ক্ষমতা হস্তান্তর করে নাই। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ একমাত্র দল যারা ২০০১ সালে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। সেজন্যও আমাদের অনেক খেসারত দিতে হয়েছিল।’
সংসদ নেতা বলেন, “একমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণে কাজ করেছে। আমরা জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করি, দেশের উন্নয়ন করি। জাতির পিতার নীতি অনুসরণ করে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন আমাদের মূল লক্ষ্য। মানুষের জীবনের শান্তি- নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাব। জাতির পিতার ভাষায় বলি, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’।”
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম