লেবার নেতাদের মন্তব্যের প্রতিবাদে বিআরআই ও আইসিএসএফের বিবৃতি
৪ জুলাই ২০২৪ ১৬:১০
যুক্তরাজ্যের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার এবং জোনাথন অ্যাশওয়ার্থের নেতিবাচক মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বিআরআই এবং আইসিএসএফ। বুধবার (৩ জুলাই) এক যৌথ বিবৃতিতে এই নিন্দা জানান হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে লেবার পার্টির স্যার কিয়ার স্টারমার এবং জোনাথন অ্যাশওয়ার্থের সাম্প্রতিক নেতিবাচক মন্তব্যে আমরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছি। তাদের এমন সংকীর্ণ মন্তব্য এমন একটি সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে, যারা ব্রিটিশ সমাজ এবং তার অর্থনীতিতে, বিশেষত এর সরকারি সেবাগুলোতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।
উপরন্তু, আধুনিক ব্রিটেনও অনেকাংশে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক বাংলা অঞ্চল থেকে আহরিত সম্পদ দ্বারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্রিটেনের ইতিহাসের ন্যায্যতম সময়ে, লাখো বাঙালি সেনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। সেইসঙ্গে নিজের জনগোষ্ঠীকে বিপদের মুখে রেখেও বাংলা বিপুল সম্পদ এবং খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে যুদ্ধে অবদান রেখেছে, যার ফলাফল ছিল একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যা লাখ লাখ বাঙালির মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের আট দশক পর, বর্তমান ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখে সেই একই ধরনের ফ্যাসিবাদী বার্তা শুনতে পাওয়া প্রবলভাবে উদ্বেগজনক। স্টারমার এবং অ্যাশওয়ার্থের এই মন্তব্য তাদের নিজেদের ইতিহাসের ব্যাপারেই কৃতজ্ঞতাহীনতা এবং অজ্ঞতার পরিচায়ক।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বাঙালি জনগোষ্ঠী ইতিহাস জুড়েই অমানবিক নৃশংসতা সহ্য করেছে, বিশেষত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। ১৭৭০ সালে বাংলার মহা মন্বন্তর, যা প্রায় এক কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল, এবং ১৯৪৩ সালের মহা মন্বন্তর, যা ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এগুলো সবই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ নীতি দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিল। একইসঙ্গে, বাঙালি জনগোষ্ঠী নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার ইতিহাসও বহন করে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, পাকিস্তান সংগঠিত গণহত্যার ফলে লাখ লাখ উদ্বাস্তু বাঙালির কথা। এমনকি আধুনিক ব্রিটেনেও, বাঙালি জনসমাজ জাতিগত বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হয়েছে (যেমন: আলতাব আলি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি)।
বিবৃতিতে বলা হয়, পৌনঃপুনিক এই বিপর্যয়গুলো বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসেরও উজ্জ্বল স্মারক, যা তাদের সামষ্টিক মানসিকতা ও জনস্মৃতিতে গভীর ছাপ ফেলেছে। সেইসঙ্গে, এগুলো একটি জনগোষ্ঠীর ঘুরে দাঁড়াবার মানসিকতা এবং মর্যাদাবোধকে নির্দেশ করে। একারণে এও অনুমেয় যে তারা স্বভাবতই এ ধরণের বৈষম্যমুলক ও অন্যায় আচরণের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারে। আমাদের গুরুতর উদ্বেগ এই যে, স্টারমার এবং অ্যাশওয়ার্থের এই ধরনের তাচ্ছিল্যসূচক বক্তব্যের ফলে দীর্ঘদিন যাবত প্রান্তিকিকৃত একটি জনসমাজের প্রতি আরও বৈষম্যমূলক এবং সহিংস আক্রমণ নেমে আসতে পারে যদি না তা সমালোচিত এবং সংশোধিত হয়। একই রাজনৈতিক দলের দু’জন শীর্ষ নেতা যখন একই নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, একইধরনের জাতিবাদি সরলীকরণ পুনরাবৃত্তি করে এবং উভয়ই তাদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনো সুস্পষ্ট ক্ষমাপ্রার্থনা এবং তা প্রত্যাহারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এড়িয়ে যায়, তখন তা লেবার পার্টির বর্তমান নেতৃত্বের একটি অংশের মধ্যে গড়ে ওঠা ‘বাঙালিবিদ্বেষ’ এর সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বিবৃতিতে লেবার পার্টির দুই নেতাকে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, অন্ততপক্ষে, এটি কাকতালীয় একটি সাঙ্ঘাতিক রাজনৈতিক ভুল তো বটেই। এ ধরণের মারাত্মক ভুলের প্রশমনকল্পে এবং তার প্রায়শ্চিত্তকরণে দলের সদিচ্ছা স্পষ্ট করতে হলে, লেবারকে অনতিবিলম্বে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক অতীতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। তা না করে, কমিউনিটি টিভি চ্যানেলে হাজির হয়ে ‘লেবার এবং বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সম্পর্কের’ ক্লিশে উদ্ধৃতি পুনরাবৃত্তি করে যে ‘উদ্বেগ’ স্যার স্টারমার ব্যক্ত করেছেন, তা কেবলমাত্র ঠুনকো ‘কথার কথা’ হিসাবেই বিবেচিত হবে। তাই আমরা স্যার কিয়ার স্টারমার এবং জোনাথন অ্যাশওয়ার্থকে তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে এবং আন্তরিক ও নিঃশর্ত কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে আহ্বান জানাচ্ছি।
ব্রিটিশ সমাজে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের অধিকার এবং মর্যাদারক্ষার জোরালো দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, শতাব্দীব্যাপী নিপীড়ন, ব্যাপকবিস্তৃত অমানবিকীকরণ এবং একাধিক গণহত্যার শিকার জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা কেবল যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের সঙ্গেই নয়, বরং যে কোনো প্রান্তিকিকৃত সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি যারা যেকোনো স্থানে, যেকারো দ্বারা জাতিবাদি সরলিকরণের মুখোমুখি হচ্ছে; সেইসঙ্গে ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টা জারি রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
উল্লেখ্য যে, ৪ জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনে তার দল ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেবেন বলে মন্তব্য করেন কিয়ের স্টারমার। লেবার পার্টি প্রধানের এমন মন্তব্যকে বর্ণবাদী বলে আখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একাধিক ব্রিটিশ এমপি।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ডেইলি সানের ইলেকশন শো ডাউন অনুষ্ঠানে লেবার লিডার স্যার কিয়ার স্টার্মার বলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলাদেশিদের মতো অবৈধ অভিবাসীদের রুয়ান্ডা নয়, বরং তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তার এই মন্তব্যের প্রতিবাদে বিবৃতি দিলো বিআরআই ও আইসিএসএফ।
বিআরআই হলো একটি স্বেচ্ছাসেবাভিত্তিক শিক্ষামূলক উদ্যোগ যা বাংলা, বাঙালি ও তদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণাকর্মে আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবীদের গবেষণাবিষয়ক শিক্ষা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সম্যক গবেষণা অভিজ্ঞতা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালি গবেষক, অধ্যাপক, পেশাজীবী ও উৎসাহী ব্যক্তিবর্গ এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছেন বাংলা ও বাঙালির প্রতি তাদের ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধের ভিত্তিতে। এছাড়াও এ সংগঠন বাঙালিত্ব সম্পর্কিত কিছু প্রাসঙ্গিক সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) আন্তর্জাতিক অপরাধের ভিকটিমদের পক্ষে কর্মরত বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত স্বাধীন বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, যা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সংগঠিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।
সারাবাংলা/আইই