Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্যবসায়ী থেকে স্ক্যামার সবার পছন্দ ভারতের যে পেমেন্ট সিস্টেম

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
১২ জুলাই ২০২৪ ১৪:৪৫

গত সাত বছর ধরে প্রতিদিন অরুণ কুমার মুম্বাইয়ের একটি ব্যস্ত রাস্তায় ফলের দোকান বসান। মুম্বাইয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য এটি সহজ কোনো কাজ নয়।

অরুণ কুমারের ভাষ্যে, মুম্বাইয়ে রাস্তার বিক্রেতা হওয়া একটি চ্যালেঞ্জ। ছিনতাই হওয়ার ভয় আছে। যেহেতু আমি লাইসেন্সপ্রাপ্ত বিক্রেতা নই তাই স্থানীয় সংস্থা এসে যে কোনো সময় আমার দোকান ভেঙে ফেলতে পারে।

তবে গত চার বছরে তার কাজের অন্তত একটি দিক সহজ হয়েছে। তিনি বলেন, কোভিডের আগে সবকিছু নগদে ছিল। কিন্তু এখন সবাই ইউপিআই দিয়ে পে করে। কোড স্ক্যান করুন এবং পে করুন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাজ শেষ। নগদ লেনদেনের কোনো সমস্যা নেই। গ্রাহকদের তরফ থেকে এই পরিবর্তন আমার জীবন এবং ব্যবসাকে মসৃণ করেছে।

ইউপিআই— যার সম্পূর্ণ নাম ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং দেশটির ব্যাংকিং শিল্পের মধ্যে সহযোগিতায় ২০১৬ সালে এই পরিষেবা চালু হয়।

ইউপিআই একটি অ্যাপ-ভিত্তিক তাৎক্ষণিক অর্থ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা, যা ব্যবহারকারীদের অর্থ পাঠানো, গ্রহণ করা এবং বিভিন্ন বিল পরিশোধের সুযোগ দেয়। ইউপিআই-এ মাত্র এক ধাপে অর্থপ্রদান অনুমোদনের সুবিধা রয়েছে। ব্যাংকে দেওয়া তথ্য-প্রমাণ বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত তথ্য এই অ্যাপে প্রবেশ করার প্রয়োজন নেই। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হলো— এটি ফ্রি।

ইউপিআই এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, ভারত এখন সবচেয়ে বড় রিয়েল-টাইম পেমেন্ট মার্কেট। গত মে মাসে ইউপিআই ১৪ বিলিয়ন লেনদেনের রেকর্ড করেছে, যা আগের বছর ছিল নয় বিলিয়নের বেশি।

কিন্তু জনপ্রিয়তা এবং সহজে ব্যবহারের কারণে এই অ্যাপটি প্রতারকদের কাছেও হয়ে উঠেছে মানুষকে ঠকানোর একটি প্রিয় জায়গা।

বিজ্ঞাপন

দিল্লি-ভিত্তিক ফিউচার ক্রাইম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্ক শেখর বলেন, যদিও ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধাজনক, তবে এই সুবিধা দুর্বলতাও নিয়ে এসেছে। স্ক্যামাররা মানুষদের প্রতারণা করার জন্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করে। যার মধ্যে রয়েছে তাদের ইউপিআই পিন নম্বর শেয়ার করার জন্য প্ররোচনা দেওয়া। অর্থ প্রদানের জন্য এই পিন নম্বরের প্রয়োজন হয়।

কিছু স্ক্যামার ভুয়া ইউপিআই অ্যাপও তৈরি করে। এই অ্যাপগুলো আসল বা বৈধ ব্যাংকিং অ্যাপের ক্লোন। তারপর লগইনের তথ্য বা অন্যান্য মূল্যবান তথ্য চুরি করে।

শেখর বলেন, দেশে যে গতিতে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটেছে, দুর্ভাগ্যবশত সেই গতিতে ডিজিটাল সাক্ষরতা বা সচেতনতা তৈরি হয়নি এবং নিরাপদ ইন্টারনেট চর্চা বাড়েনি।

তিনি বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সমস্ত আর্থিক জালিয়াতির প্রায় অর্ধেকের সঙ্গেই ইউপিআই সিস্টেমের ব্যবহার জড়িত। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে শেষ হওয়া আর্থিক বছরে ইউপিআই-এর সঙ্গে জড়িত জালিয়াতির ঘটনা ৮৫ হাজারের বেশি, যা আগের বছর ছিল ৭৭ হাজারের বেশি।

এমন এক জালিয়াতির শিকার বিহারের ২২ বছর বয়সী তরুণী শিবকালী। তার স্বপ্ন ছিল একটি স্কুটার কেনা। কিন্তু স্কুটারের দাম ছিল বাজেটের বাইরে। বছরের শুরুর দিকে তিনি ফেসবুকে একটি স্কুটার বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখেন। স্কুটার ও দাম দেখে বেশ পছন্দ হয় তার। তিনি বলেন, আমি কোনো কিছু না ভেবেই এই সুযোগটা নিয়ে নেই।

শিবকালী জানান, কয়েকটি ক্লিকের পর এবং স্কুটারের মালিকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয় তিনি আমাকে ২৩ ডলারের বিনিময়ে স্কুটারের কাগজপত্র পাঠাবেন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তাই শিবকালী তাৎক্ষণিক স্কুটারের মালিককে টাকা পাঠিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি স্কুটারের জন্য ২০০ ডলার পাঠান। কিন্তু স্কুটারটি তিনি আর বুঝে পাননি। শিবকালী বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, আমি কখনও ভাবিনি আমি প্রতারিত হতে পারি। কারণ আমার কিছু শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আমি জানি বিশ্বে কী ঘটছে, কিন্তু স্ক্যামাররা বুদ্ধিমান। তারা মানুষকে অনেককিছু বোঝাতে পারে।

ভারতের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউপিআই ব্যবহারকারীদের স্ক্যামারদের কবল থেকে রক্ষা করার উপায় খুঁজছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ চাইলে তাকে তার ব্যাংকেরই দ্বারস্থ হতে হবে।

আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. দুর্গেশ পান্ডে বলেন, সমস্যার গোঁড়া গভীরে। অধিকাংশ ব্যাংক এবং টেলিকম সংস্থা গ্রাহকের পরিচয় পরীক্ষা করার ব্যাপারে শিথিলতা দেখায়। তাই প্রতারককে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলোর জন্যও চ্যালেঞ্জ আছে। তারা যদি অ্যাকাউন্ট খোলা ও লেনদেনের ক্ষেত্রে খুব কঠোর হয় তাহলে সমাজের দুর্বল একটি গোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসতে পারবে না। ফলে ব্যাংকগুলোকে সহজে ব্যবসা পরিচালনা এবং পরিচয় শনাক্তের কঠোরতার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

ড. পান্ডে অবশ্য বলছেন, বেশিরভাগ জালিয়াতির ক্ষেত্রেই আসলে ব্যাংক দায়ী নয়। কে দায়ী- এই প্রশ্নটাই জটিল। কারণ সমস্যাটি ব্যাংকগুলোর কারণে হয়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীই লেনদেনের অনুমতি দিচ্ছেন। তাই আমি বলব, ভুক্তভোগী এবং ব্যাংক উভয়কেই ক্ষতি বহন করতে হবে।

এই সমস্যাগুলো সত্ত্বেও ইউপিআই গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণ ব্যবস্থায় ব্যাংকিং পরিষেবার আওতায় আসতে না পারে গ্রামগুলোতে ইউপিআইয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং পরিষেবা ছড়িয়ে পড়ছে।

রাজস্থানের পুনম উনটওয়াল একটি গাইডেন্স সেন্টার চালান। সেখানে তিনি মানুষকে ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবহার করতে সাহায্য করেন।

তিনি বলেন, আমাদের অধিকাংশই তেমন শিক্ষিত নয়। আমরা স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহারও জানি না। আমি তাদের শেখাই যে ফোন এখন আর কেবল মানুষের সঙ্গে কথা বলার যন্ত্র নয়, ফোনের মাধ্যম ব্যাংকও এখন হাতের মোঠয়। তিনি বিশ্বাস করেন, ইউপিআই স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশে সহায়তা করবে।

পুনম বলেন, আমার মতো অনেক নারীর ক্ষুদ্র ব্যবসা আছে যা আমরা আমাদের বাড়ি থেকেই চালাই। এখন আমরা ইউপিআই-এর মাধ্যমে লেনদেন করতে পারি। যাদের স্মার্ট ফোন নেই তারা লেনদেনের জন্য আমার কেন্দ্রে আসে।

ভারতের গ্রামীণ এলাকায় প্রবেশের পাশাপাশি ইউপিআই বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। ভুটান, মরিশাস, নেপাল, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের খুচরা বিক্রেতারা এখন ইউপিআই এ পেমেন্ট নেন।

এই বছর ইউরোপীয় দেশ হিসেবে প্রথম ইউপিআই পেমেন্ট গ্রহণ করেছে ফ্রান্স। সেদেশে আইফেল টাওয়ারের টিকিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন লেনদেন ইউপিআইয়ের মাধ্যমে করা যায়।

এদিকে, মুম্বাইয়ের রাস্তার ফল বিক্রেতা অরুণ কুমার খুশি। কারণ, তাকে আর নগদ ব্যবহার করতে হয় না। তবে তিনি সতর্ক। কারণ, ভালো ইন্টারনেট সংযোগ না পেলে গ্রাহকদের লেনদেন অনেক সময় সম্পন্ন নাও হতে পারে। ফলে কেউ টাকা না দিয়েই চলে যেতে পারে।

কুমার বলেন, আমার মতো একজন ছোট বিক্রেতার জন্য ইউপিআই অর্থ লেনদেন খুব সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু আমি সবসময় প্রতারণার ভয়ে থাকি। আমি খবরে শুনি কিভাবে ইউপিআই জালিয়াতি বাড়ছে। আশা করি এমন কোনো উপায় বের হবে, যেন আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জালিয়াতির শিকার না হয়। সূত্র: বিবিসি

সারাবাংলা/আইই

ইউপিআই