শ্রদ্ধার ফুল নিয়ে স্মৃতির ক্যাম্পাসে চিরঘুমে মাহবুবুল হক
২৬ জুলাই ২০২৪ ১৮:২০ | আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪ ১৮:২১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহযোদ্ধাসহ দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা নিয়ে নিজের স্মৃতিমাখা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গণে সমাহিত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক।
যে শহরে বেড়ে ওঠা, রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, সেই চট্টগ্রাম শহরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে শুক্রবার (২৬ জুলাই) সকালে কফিনবন্দি হয়ে আসেন মাহবুবুল হক। বেলা ১২টা পর্যন্ত সেখানে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কফিনে শ্রদ্ধা জানানো হয়। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সহযোদ্ধারা অশ্রুসজল নয়নে তার স্মৃতিচারণ করেন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘মাহবুবুল হকের বিচরণ ছিল সর্বক্ষেত্রে। একজন মানুষ পুরোদস্তুর রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত করেছেন শুধু নয়, শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চায় রীতিমতো আন্দোলন করে গেছেন। সংস্কৃতির সংগ্রাম করেছেন, নাগরিক সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন। কাঠামোবদ্ধ দলীয় রাজনীতি করেছেন, আবার শিক্ষকতাও করেছেন। গবেষণায় যুক্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে অনন্য মর্যাদার আসনে নিয়ে যেতে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছেন।’
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মাহবুবুল হক চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এদেশের ইতিহাসে তার একটি স্থায়ী আসন তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ, এদেশের মানুষ তাকে যুগে যুগে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির, চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি অধ্যাপক অশোক সাহা বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহবুব ভাই চট্টগ্রামে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি ঊনষত্তরের গণঅভ্যুত্থানের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আবার যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল, তিনি গেরিলা যোদ্ধা হয়ে রণাঙ্গণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্বাধীনতার পর দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এদেশের বাম আন্দোলনের উনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এমন নীতিনিষ্ঠ সংগঠক এখন বিরল। আমরা তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’
মাহবুবুল হকের মেয়ে উপমা মাহবুব সমবেতদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার বাবা সারাজীবন দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি দেশ নিয়ে ভেবেছেন। নিজের সন্তান ও নাতিদের দেশপ্রেমের পাঠ শিখিয়েছেন। আমি শুধু আমার বাবাকে হারায়নি, দেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজনকে হারিয়েছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। আমি চাইবো আমার বাবার মতো সবাই যেন দেশকে নিয়ে ভাবেন, পাশে থাকেন।’
মাহবুবুল হকের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ বলেন, ‘আমি ও মাহবুব ভাই একসঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করেছি। উনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন আর আমি করতাম ছাত্রলীগ। ৬৯’র গণ অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছি। রনাঙ্গনে একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। জাতির জন্য তার আরও অনেক কাজ করে যাওয়া বাকি ছিল।’
কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদলের সঞ্চালনায় এসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মু. আবু তাহের, উপ-উপাচার্য সেকান্দর চৌধুরী ও বেণু কুমার দে, চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবিএম আবু নোমান, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু বক্তব্য রাখেন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান প্রয়াতের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এছাড়া সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী চট্টগ্রাম, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনী, খেলাঘর, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, গ্রুপ থিয়েটার ফোরাম, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, পরিকল্পিত নাগরিক ফোরাম, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের একাংশ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, চবি বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড, চবি উদীচীসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়াতের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গনে মাহবুবুল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হয় জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চবির কেন্দ্রীয় মসজিদে বিকেলে আরেকদফা জানাজা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
এর আগে, বুধবার (২৪ জুলাই) দিবাগত রাত পৌনে ২টায় ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহবুবুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় তার জন্ম। বাবার চাকরিসূত্রে বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে।
মাহবুবুল হক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি অর্জন করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে প্রথমে তিনি বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে যান।
শিক্ষকতার পাশাপাশি মাহবুবুল হক বাংলা ও নৃতাত্ত্বিক ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মরীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখে তিনি ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি পান। বাংলাদেশ, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে শিক্ষানীতি ও পাঠ্যবই প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১৯ সালে তিনি ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক পান। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ছাত্রজীবনেই মাহবুবুল হক প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি
অধ্যাপক টপ নিউজ ড. মাহবুবুল হক বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাষাবিজ্ঞানী সমাহিত