Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাবমূর্তি হারাল আইসিটি খাত, ক্ষতির অঙ্ক অজানা

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৮ জুলাই ২০২৪ ২১:৪৭

ঢাকা: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা, নাশকতা ও প্রাণহানির ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট ফিরেছে। এর আগে, প্রায় চার দিন বন্ধের পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও সচল হয়। তবে এখনও ইন্টারনেটে ধীরগতি রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটকসহ বেশকিছু অ্যাপস। প্রায় ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় শুধুমাত্র ই-কমার্স খাতেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রথম পাঁচ দিনে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিস। যদিও সংগঠনটি ক্ষতির সঠিক পরিমাণ এখনো নিরূপণ করতে পারেনি।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির চেয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন আইসিটি খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে। যেকোনো দুর্যোগের সময় ফ্রিল্যান্সার ও আইটি খাতের কোম্পানিগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, পাঁচ দিন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সফটওয়্যার খাতে ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। গত ২৩ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি রাসেল টি আহমেদ জানায়, গত ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় পাঁচ দিনে সফটওয়্যার খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কাও করে সংগঠনটি। যদিও সংগঠনটি এখন পর্যন্ত ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করতে পারেনি। ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব জানতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে তারা।

জানতে চাইলে রোববার (২৮ জুলাই) বিকেলে বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম রাশিদুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষতির সঠিক পরিমাণ এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। আমরা ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছি। আজও মিটিং হয়েছে। আমরা বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে মিটিং করব। এর পর ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে বলেছিলাম রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিদিনে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রথম পাঁচ দিনের হিসাবে সেই পরিমাণের কথা বলা হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে। আমরা এই সপ্তাহের শেষ দিকে প্রকৃত ক্ষতির হিসাব জানাতে পারব।’

এদিকে, সরকারের কাছে লেখা এক চিঠিতে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার বলেছেন, ‘বর্তমান দেশের পরিস্থিতি ই-কমার্স খাতে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ উদ্যোক্তা ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল। গত ১০ দিনে এ খাত প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই বিপর্যয় ই-কমার্স, এফ-কমার্স, লজিস্টিকস, ই-ট্যুরিজম এবং অন্যান্য ডিজিটাল সেবা খাতে প্রভাব ফেলেছে, যেখানে প্রায় ২০ লাখ কর্মশক্তি কাজ করেন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ এবং নারী।’

চিঠিতে আরও লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ই-কমার্স লজিস্টিকস প্রতিদিন প্রায় আট লাখ পণ্য সরবরাহ করে। তবে, বর্তমান বিপর্যয়ের কারণে এই সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে, যা ব্যবসার কার্যক্রমকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।’

যা বলছেন উদ্যোক্তারা

বিডি জবসের প্রতিষ্ঠাতা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইসিটি খাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার প্রকৃত হিসাব তো আর পাওয়া যাবে না। তবে ভবিষ্যতে দেশের আইসিটি খাত বড়ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। অনেক কোম্পানি তাদের ক্লায়েন্ট হারিয়েছে। ভবিষ্যতে ওই ক্লায়েন্ট ধরা তাদরে জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তবে, লোকাল মার্কেটে যারা ব্যবসা করেন তারা হয়তো তাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবের। কিন্তু আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এখনও ফেসবুক বন্ধ। বেশিরভাগেরই ব্যবসা কিন্তু ফেসবুককেন্দ্রিক। যারা ই-কমার্স ব্যবসা করেন, তাদের ব্যবসার ৬০ ভাগই ফেসবুকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে ক্ষতির হিসাব দেওয়া যাচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবাই ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে একেকটি নম্বর বলছে। কিন্তু কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা যাবে না। তবে যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদী। একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগামী ১০ বছর কাজ হওয়ার কথা, কিন্তু এখন বিদেশে ওই প্রতিষ্ঠান দেশীয় কোম্পানির প্রতি আস্থা হারিয়েছে। ইউক্রেনের মতো দেশেও কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে ইন্টারনেট চালু রয়েছে। সেখানকার আইটি কোম্পানিগুলো কাজ করে যাচ্ছে। রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন এখন ভেঙে গেল। আইসিটি খাত সবচেয়ে বড় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেটি হলো- ইমেজ হারানো। বাংলাদেশকে এখন আর প্রমিজিং ডেস্টিনেশন হিসেবে গণ্য না করে রিস্কি ডেসটিনেশন হিসেবে গণ্য করা হবে। এখন আমাদের এমন কিছু করতে হবে যাতে যেকোনো ক্রাইসিসে টেকনোলজি কোম্পানি ও ফ্রিল্যান্সারদের নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগে রাখা যায়।’

বেসিসের আরেক সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি হিসাবে দেশে সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। এদের চার ভাগের এক ভাগও কাজ করছে যদি এমনটি ধরা হয়; আর ঘণ্টায় ১০ ডলার করে আট ঘণ্টায় দিনে ৮০ ডলার আয়ের হিসাব যদি ধরি, তবে শুধু ফিল্যান্সিং খাতেই দিনে ১৩ মিলিয়ন ডলার আয় হওয়ার কথা। বিপিওতে ১৩ মিলিয়ন ডলার, সফটওয়্যারে ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলার যদি ধরা হয়, তবে দিনে আইসিটি খাতে ৩০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে। সবমিলিয়ে ক্ষতির অঙ্কের হিসাব অনেক বেশি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এই ক্ষতিগুলো হয়তো আগামী দুই তিন মাসে পুষিয়ে নেব। ইমেজের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কীভাবে পুষাব? বিদেশি ক্লায়েন্টরা তো মনে করবেন, এই দেশের ফ্রিল্যান্সাররা আনপ্রফেশনাল। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ভাবমূর্তির।’

ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে তিনটি কাজ করা যেতে পারে এমন পরামর্শ দিয়ে আলমাস কবীর বলেন, ‘ইমেজ ফিরিয়ে আনতে বিদেশি ক্রেতাদের বলতে হবে, এটি আমাদের জন্য একটি অ্যাকসিডেন্ট ছিল। কোনো ক্রাইসিসে আর এমনটি হবে না। দুর্যোগকালীন আমরা স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকব। সেলক্ষ্যে ভিস্যাট লাইসেন্স দিতে হবে। আইসিটি কোম্পানি ও ফ্রিল্যান্সাররা ভিস্যাট’র মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এ ছাড়া সব মোবাইল অপারেটর ও আইআইজি অপারেটরদের বলতে হবে, শুধু ডাটা সেন্টার নয়, রিকভারি ডাটা সেন্টারও তাদের থাকতে হবে। দুর্যোগের সময়ে রিকভারি ডাটা সেন্টার থেকে ইন্টারনেট সরবরাহ ব্যবস্থা চালু থাকবে। এ ছাড়া নতুন টেকনোলজিতে দক্ষতাসম্পন্ন জনবল গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে সফটওয়্যার টেনলোজি পার্কগুলোতে সবসময় যাতে ইন্টারনেট থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগের সময়ে যদি দেশের সব যায়গায় ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে, তখন ওই ভবনে যাতে দুটি বা তিনটি ফ্লোর থাকে, যেখানে এসে ফিল্যান্সাররা বা প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে।’

নেট ব্যবহার করতে নেপালে

দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নেট চালাতে নেপালে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন আইটি প্রতিষ্ঠান ও ফ্রিল্যান্সাররা নেপালে গিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কেউ কেউ গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। গেল ২৪ জুলাই নেপালে পাঁচ কর্মীকে পাঠায় এক্সিলওয়েব লিমিটেড নামের একটি আইটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (অপারেশন) জামিল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গেল ২৪ জুলাই আমরা পাঁচ জনের একটি টিম নেপালে যাই। কারণ, আমাদের সার্ভার ডাউন হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা এয়ারপোর্টে নামার পরপরই নোটিফিকেশন পাই। নেপালের এয়ারপোর্টে বসেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারি। এর মধ্যে আমরা দু’জন ঢাকায় ব্যাক করেছি। নেপালে এখনও আমাদের তিন জনের একটি টিম রয়ে গেছে।’

এদিকে, ফ্রিল্যান্সার ও আইটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নেট চালাতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যাচ্ছেন- গেল কয়েকদিন আগে এমন বক্তব্য উঠে আসে খোদ ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের বক্তব্যেও।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

আইসিটি খা ভাবমূর্তি শঙ্কা

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর