বন্যাদুর্গত এলাকায় বড় চ্যালেঞ্জ বিশুদ্ধ পানি, মোকাবিলায় যা করণীয়
৩০ আগস্ট ২০২৪ ২২:৫১
ঢাকা: ভয়াবহ বন্যার কবলে দেশের পূর্ব, উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্বের ১১ জেলা। অনেক এলাকা। ধীরে ধীরে কমলেও অনেক এলাকায় এখনো হাজারও মানুষ পানিবন্দি। যেসব এলাকায় বন্যার পানি কমছে, সেখানেও বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষত। এই মুহূর্তে বন্যাদুর্গত এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। আর তার প্রভাবেই পানিবাহিত নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাবও দেখা যাচ্ছে। ডায়রিয়া ও টাইফয়েড ছাড়াও নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছেন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যা-পরবর্তী এই সময়ে বিশুদ্ধ পানির উৎস সহজলভ্য নয়। নিরাপদ পানির অভাবে অনেকেই খাবার ও দৈনন্দিন কাজে অনিরাপদ পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। তাতেই বেড়ে যায় স্বাস্থ্যঝুঁকি। তাই সবার আগে বন্যা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে পানি বিশুদ্ধিকরণের বিষয়টিকে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব।
বন্যার পানি কমে আসতে থাকলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মাধ্যমেই ত্রাণ কার্যক্রম চলছে বন্যার্ত এলাকাগুলোতে। এসব ত্রাণের মধ্যে অনেকেই পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রাখছেন, যেন বন্যার্তরা সেগুলো ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধ করে নিতে পারে। তবে সেই ট্যাবলেটের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ কম যাচ্ছে বলে সেসব এলাকায় এই ট্যাবলেট যাচ্ছেও না। এ পরিস্থিতিতে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট হ্যালোট্যাব ছাড়াই ঘরে পানি বিশুদ্ধ করার বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণের দিকে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঘরে পানি বিশুদ্ধ করার উপায় কী?
কলেরা হাসপাতাল নামে সুপরিচিত আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) পানি বিশুদ্ধ করার বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে। ধাপে ধাপে সেই পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করা হলো।
বন্যার পানি বিশুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ (১/২/৫ লিটার) পানি একটি পাত্রে নিতে হবে। দুটি ধাপে পানিকে নিরাপদ করতে হবে।
প্রথম ধাপ
প্রথম ধাপে পানির স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য দুটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে—
১. পানিকে বিশুদ্ধ করার উপযোগী করে তুলতে ফিটকিরি ব্যবহার করতে হবে। এক লিটার পানির জন্য এক চিমটি (০.৫ গ্রাম) ফিটকিরি পানিতে ভালোভাবে গুলিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। পানিতে থাকা ময়লাগুলো তলানিতে জমা হলে একটি পাত্রে পানি ঢেলে নিতে হবে।
২. চার থেকে আট ভাঁজ পরিষ্কার পাতলা কাপড় দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি ছেঁকে নিতে হবে।
এই দুইটি প্রক্রিয়ার যেকোনো একটি অনুসরণ করার পরে পানি একটি পাত্রে ঢেলে নিতে হবে। এই দুই প্রক্রিয়ায় পানির স্বচ্ছতা বাড়ানো হয়ে থাকে। এরপর পানিকে বিশুদ্ধ বা নিরাপদ করার জন্য দ্বিতীয় ধাপ অনুসরণ করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ
পানিকে বিশুদ্ধ বা নিরাপদ করার জন্য তিনটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে—
১. ফুটানো: প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি কমপক্ষে ৩ মিনিট ধরে ফুটন্ত অবস্থায় রাখার পর ঠান্ডা করে নিতে হবে। এই পানি পান করার জন্য নিরাপদ।
২. ব্লিচিং পাউডার: এক লিটার পানির জন্য এক চিমটি ব্লিচিং পাউডার পানিতে ভালোভাবে গুলিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এরপর এই পানি পান করার জন্য নিরাপদ হবে।
৩. পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট: পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট প্রয়োজনমতো পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে গুলিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য ট্যাবলেটের ব্যবহারবিধি অনুসরণ করতে হবে।
আইসিডিডিআর,বির ডা. লুবাবা শারমিন সারাবাংলাকে বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি দেখা যেতে পারে। বিশুদ্ধ পানি পান না করার ফলে অনেক অসুখই হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম পেটের নানা ধরনের অসুস্থতা। সবচেয়ে বেশি দেখা দিতে পারে ডায়রিয়া বা আমাশয়। বিশুদ্ধ পানির অভাবে এগুলো প্রকট আকারেও দেখা দিতে পারে।
সাধারণ সময়ে টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হলেও বন্যার সময় সেই পানি ব্যবহারেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন এই চিকিৎসক ও গবেষক। তিনি বলেন, বন্যার সময় অধিকাংশ টিউবওয়েলই পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় ছিল। তাই সেগুলোর পানি পান করার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। কারণ টিউবওয়েলে পানি তো আসে ভূগর্ভস্থ লেয়ার থেকে। সেই ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে বন্যার দূষিত পানি মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এ ক্ষেত্রে ওপরের পদ্ধতিগুলো অনুসরণে জোর দিয়ে ডা. লুবাবা বলেন, কারও যদি রিজার্ভে পানি থাকে, সেটাকে নিয়ম অনুযায়ী ব্লিচিং পাউডার বা ফিটকিরি বা এ ধরনের উপকরণ ব্যবহার করেই বিশুদ্ধ করে নিতে হবে। তবে পান করার জন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি পানি ফুটিয়ে নেওয়া। অনেক স্থানে পানি ফুটানোর জন্য চুলা জ্বালানো চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তখন ফিটকিরি বা হ্যালোট্যাবের মতো উপকরণ ব্যবহার করে রাসায়নিক পদ্ধতির দিকে জোর দিতে হবে।
বন্যায় ডুবে থাকা টিউবওয়েলের পানি ব্যবহারে সতর্কতা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার পানিতে ডুবে থাকা টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করার আগে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে টিউবওয়েলের পানি ব্যবহারের আগে ১৫০ থেকে ২০০ বার চেপে পানি ফেলে দিতে হবে। এরপর টিউবওয়েলের যে দিকটা দিয়ে পানি বের হবে, সেটা ব্লিচিং পাউডার বা সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর আরও কিছু পানি চাপ দিয়ে ফেলে দিতে হবে।
পরবর্তী ধাপে একটি কাপড়ে আগুন দিয়ে টিউবওয়েলের যে দিকটা দিয়ে পানি বের হয় সেদিকে তাপ দিতে হবে। যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থাকে, এর মাধ্যমে সেগুলো পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে। আর তারপরই টিউবওয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর